রোমান্টিক প্রেম গড়ে উঠেছিল লাবণ্য(বন্যা) ও অমিত(মিতা) র মধ্যে, যে প্রেমের পরিণতি ট্রাজেডি হলেও অমিত ও লাবণ্যের প্রেমকে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে অম্লান করে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ 'শেষের কবিতায়' এক রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে।
অমিত লিখলো তাঁর শেষের কবিতা .........
"তব অন্তর্ধান পটে হেরি তব রূপ চিরন্তন।
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার অন্তিম আগমন।
লভিলাম চিরস্পর্শমণি;
তোমার শূন্যতা তুমি পরিপূর্ণ করি গিয়েছো আপনি।।


জীবন আঁধার হোলো, সেই ক্ষণে পাইনু সন্ধান
সন্ধ্যার দেউলদীপ, চিত্তের মন্দিরে তব দান।
বিচ্ছেদের হোমবহ্নি হতে
পূজামূর্তি ধরে প্রেম, দেখা দেয় দুঃখের আলোতে।"


ইতি
অমিত(মিতা)


উত্তরে লাবণ্য(বন্যা) লিখলো তার শেষের কবিতা অমিত কে উদ্দেশ্য করে ......
"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
....................................................
..................................................
তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।


ইতি
লাবণ্য(বন্যা)  


'শেষের কবিতা' শুধুমাত্র বাংলা সাহিতাকে সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, এটা তাঁর অন্যতম দুর্দান্ত উপন্যাস।শেষের কবিতায় লাবনোর ত্যাগ এবং তার সিদ্ধান্তের প্রতি অমিতের প্রতিক্রিয়া অহংকার এবং প্লাটোনিক প্রেমকে উপস্থাপন করে।অমিত একটি ধনী পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ব্যারিস্টার অমিত গোঁড়া সমাজের রীতিনীতি বিধি ভেঙে দিতে চান।গাড়ি দুর্ঘটনার সময় তিনি অত্যাশ্চর্য লাবণ্যের দেখা পেলেন। উপন্যাসে লাবণ্যের  সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন এইভাবে যা তাঁর আত্মবিশ্বাস একটি শক্তিশালী চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। লাবনোর ব্যক্তিত্ব, অহংকার এবং জ্ঞান অমিতের জীবনে তাজা বাতাসের শ্বাসের মতো ছিল।নারী চরিত্রটিকে কবিগুরু নারীবাদ এবং নারী ক্ষমতায়নের  আইকনিক করে তুললেন।উপন্যাসের অন্যান্য মহিলা চরিত্রগুলিও খুব আকর্ষণীয়। তারা সমস্ত নিজস্ব উপায়ে অনন্য।


দুজনের গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কা খেলো।অমিত অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো তার বাসার দিকে শিলংয়ের খাদ ও জঙ্গল ভরা রাস্তায়।বাঁকের কাছে আসতে টাল সামলাতে না পেরে ধাক্কা লাগালো উল্টোদিক থেকে আসা আরো একটা গাড়ির সঙ্গে। আসা গাড়িটা পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে আটকে গেলো। গাড়ি থেকে নেমে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটির পরনে সরু পাড় দেয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ী। তনু দীর্ঘ দেহটি ,বর্ণ চিকন শ্যাম,টানা চোখ,প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল বাঁধা,চিবুক ঘিরে মুখের ডৌলটি ফলের মতো রমণীয়। অমিত এগিয়ে এসে বললো "অপরাধ করেছি"। মেয়েটি হেসে বললো "অপরাধ নয়,ভুল।সেই ভুলের শুরু আমার থেকেই। প্রেমের শুরু এখানে এই মুহূর্ত টুকু থেকে।  
অমিতের কাছে লাবণ্যের ব্যক্তিত্ব কবি ফুটিয়ে তুলেছেন ঠিক এইভাবে ...
অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা অমিত জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে ।তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমা-রাত্রির মতো, উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন; লাবন্যর সৌন্দর্য সকাল-বেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে গড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন; তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয়, সেই সঙ্গে আছে মননের শক্তি। এটাই অমিতকে এত আকর্ষণ করেছে। অমিতের নিজের মধ্যে বুদ্ধি আছে, ক্ষমা নেই, বিচার আছে ধৈর্য নেই; ও অনেক জেনেছে, শিখেছে, কিন্তু শান্তি পায় নি। লাবণ্যর মুখে ও এমন একটি শান্তির রূপ দেখেছিল যে শান্তি হৃদয়ের তৃপ্তি থেকে নয়, যা ওর বিবেচনাশক্তির গভীরতায় অচঞ্চল।
অমিতের কথায় ‘ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইল মুখশ্রী।’ বর্তমানে আমরা ফ্যাশন ও স্টাইল সম্পর্কে নতুনভাবে জানছি যা অনেক  আগেই কবি ব্যবহার করেছেন শেষের কবিতায়। বললেন ‘লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট- প্রতিদিন তাকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই।’ দাম্পত্যকে আর্টের সঙ্গে তুলনা করে দাম্পত্যের সম্পর্ককে আরও বেশি গতিময় করেছেন। উপন্যাস টিতে প্রেম আছে, বিরহ আছে, বিচ্ছেদ আছে, কাব্যিক ছন্দময়তা আছে, হাস্যরস আছে। কবিতার ভাষাগত শৈলী অপূর্ব।গদ্য সাহিত্যের মধ্যেও যে ছন্দময়তা থাকতে পারে, তা শেষের কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে মানুষ অনেক দেবতার পূজারি, আড়ালে সব দেবতাকেই সে সব দেবতার চেয়ে বড়ো ব’লে স্তব করে; দেবতাদের বুঝতেও বাকি থাকে না অথচ খুশিও হন। কন্যার মাতাদের আশা কিছুতেই কমে না, কিন্তু কন্যারা বুঝে নিয়েছে অমিত সোনার রঙের দিগন্ত রেখা- ধরা দিয়েই আছে তবু কিছুতেই ধরা দেবে না। মেয়েদের সম্বন্ধে ওর মন তর্কই করে, মীমাংসায় আসে না। সেই জন্যই গম্যবিহীন আলাপের পথে ওর এত দুঃসাহস।অমিত ছন্নছাড়া এবং কারও যুক্তিকে সে তোয়াক্কা করে না। সে নানান যুক্তির মধ্য দিয়ে তার কথাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যেমন, তাজমহলের পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের ভক্ত আরক্তমুখে বলে উঠল, ‘ভাল জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো।’কিন্তু অমিত বলল তার ঠিক উল্টোটা, ‘বিধাতার রাজ্যে ভাল জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি। উপন্যাসে চর্তুভূজ প্রেম নির্ভরতার প্রয়াস পাওয়া যায়। যেমন- অমিতর সঙ্গে কেতকীর, লাবণ্যের সঙ্গে অমিতর, আবার শোভনলালের সঙ্গে লাবণ্যের। দ্বৈত প্রেমের আবেশে নিবিষ্ট উপন্যাসটি। যার প্রমাণ মেলে অমিতের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে, ‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালবাসা, সে রইল দীঘি। সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’ অথবা, ‘যে ভালবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে থাকে অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতেই যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।’
সম্পর্কের এক পর্যায়ে এসে লাবণ্য বুঝতে পেরেছিল, অমিতকে সে হয়তো জীবনে আর পাবে না। তাই তো সে বলেছিল, ‘তুমি আমার যত কাছেই থাক তবু আমার থেকে তুমি অনেক দূরে।’লাবণ্য সর্বদা ছিল শান্ত ও নিবিড়।লাবণ্য বললো ‘আমাকে তুমি কোন আংটি দিয়ো না।  কোন চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন।


অন্যদিকে, লাবণ্যের বাল্যবন্ধু শোভনলাল লাবণ্যকে চিঠি দিয়ে জানাল সে, শিলঙে এসেছে। লাবণ্যও চিঠির প্রত্যুত্তর দিলো। এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ঠেকলো বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত। অতঃপর যতিশংকর লাবণ্যের লেখা একটি চিঠি এনে অমিতের হাতে দিলো। এর এক পৃষ্ঠায় ছিলো লাবণ্য ও শোভনলালের বিয়ের খবর অন্য পৃষ্ঠায় একটি সুদীর্ঘ কবিতা এবং সেটাই হলো শেষের কবিতা। যতিশংকরের হাত থেকে লাবণ্যের চিঠি পাওয়ার পরও অমিতের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। যেখানে শোভনলালের সঙ্গে ছয় মাস পরে লাবণ্যের বিয়ের দিন ধায্য হয়েছে।
অমিতের ভালবাসার সব দানকে লাবণ্য অকপটে স্বীকার করে নিলো। ভালবাসার দায় যে মানুষকে ঋণী করে সে কথাই যেনো শেষের কবিতার মাধ্যমে লাবণ্য জানান দিলো। অমিতের কথায়, ‘মন যখন খুব বড়ো হয়ে ওঠে তখন মানুষ যুদ্ধও করে, ক্ষমাও করে।’ লাবণ্য যুদ্ধ করে অমিতের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো।
উপসংহার:
একধরণের গভীর অনুভূতি রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় উপলব্ধি করা যায়।রবীন্দ্রনাথ দুজন মানব-মানবীর প্রেমের কাহিনী লিখলেন। তাও এ কোনো সররৈখিক প্রেম নয়, এ প্রেম চর্তুভুজাকৃতির।জীবনের শেষ প্রান্তে রচিত হলো কালজয়ী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। বইটির জনপ্রিয়তা ব্যাপক এবং পাঠ্যবহুলতার মধ্যে রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের খুব কম বই-ই এমন জনপ্রিয়তার কাতারে পৌঁছাতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ তার সৃষ্টি, শিল্প, কাব্যময়তায় এক অনন্য ভাষার ব্যবহার ঘটিয়েছেন 'শেষের কবিতা' উপন্যাসে।প্রত্যেকবার পড়ার পরেও যেন মনে হয় অমিত ও লাবণ্যের প্রেমের মতো যেন পড়াটাও অসমাপ্ত রয়ে গেলো।


টিকা:
শেষের কবিতায় তিনি যে ভাষার ব্যবহার ঘটিয়েছেন তা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারারই উন্মেচক।রোমান্টিসিজম ও বাস্তববাদিতার মিলনে সবকিছুকে তোয়াক্কা না করে অমিত-লাবণ্য একে অপরের প্রণয়ের আলিঙ্গনে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একবারও সে বন্ধনকে খেলো হতে দেয়নি তারা। একদম শেষপর্যন্ত দেখা যাবে যে তারা একে অপরের কতটা কাছে আছে, তার পরিমাপ করাটা অনেক কষ্টকর।