"গজল" নামের সঙ্গে কেমন যেন একটা মাদকতা জড়িয়ে থাকে। শায়েরি, রুবাইয়াৎ ও গজল প্রায় কাছাকাছি হলেও তিনটির ধরণ ও চরিত্র আলাদা। একটা তীব্র অসহায় বোধ, একটা তীব্র মানসিক কষ্ট থেকে জন্ম নেয় গজলের। আসলে গজল বলতে আমরা ঠিক কবিতা বুঝিনা। বুঝি গান। তবু কবিতার আকারে না লিখলে গান তৈরী হবে কিকরে? একটা শিকারী কুকুরের আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একটা শিশু হরিণ ভয়ে পালাচ্ছে। আর তার কচি শিংদুটো আটকে গেলো একটা গাছে। কিছুতেই তার শিংদুটোকে ছাড়াতে পারছেনা। সেই হরিণ শিশুটির তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? হরিণ শিশুটির কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে এলো এক তীব্র আর্তনাদ! কষ্টের এই সেই অনুভূতি যখন কবির মনে সৃষ্টি হয় তখন কবি রচনা করেন গজল।


গজল একসময় সীমাবদ্ধ থাকতো রাজমহলের অন্তরালে। সময়ের পরিক্রমায় গজলের সৌন্দর্য আচ্ছন্ন করেছে বিপুল শ্রোতার মনকে। গজল শব্দের আভিধানিক অর্থ করলে দাঁড়ায় 'প্রেমালাপ' । এটি একটি আরবি শব্দ হলেও পরে উর্দুতেও এর বিকাশ ঘটেছে। যদিও সংগীত হিসেবে আমরা গজল কে চিনি কিন্তু এর শুরুটা কিন্তু কবিতা দিয়ে। কারণ গজল প্রথমে সংগীত হিসেবে সীকৃতি পায়নি পেয়েছিলো কবিতা হিসেবে। একটা সময় কাব্যকে আবৃত্তি করে সুর দেবার রীতি ছিল। উর্দুতে গজলের প্রবর্তন হয় ফার্সি কাব্যকে অনুকরণ বা অনুসরণ করে। মোগল আমলে এই গজল শুরু।  'আমীর খসরু' কে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করা হয় গজলের প্রবর্তক হিসেবে। সুলতান নাজিম উদ্দিন আর আমীর খসরু দুজনের ছিল গলায় গলায় বন্ধুত্ব। রোজ সন্ধ্যে বেলায় আমীর খসরু তাকে গজল শোনাতেন আর দুজনে কান্নায় ভেঙে পড়তেন।  


"চিঙ্গারি কোই ভড়কে তো শাওন উসে বুঝায়ে
শাওন জো আগ লাগায়ে উসে কোন বুঝায়ে"


এটি অত্যন্ত একটি জনপ্রিয় গজল। হিন্দি মুভি 'অমরপ্রেম' ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে গাওয়া। গজল  টির রচয়িতা 'আনন্দ বক্সি' ।  
আমার বাংলা অনুবাদ করা এই গজলটির অনুবাদ এই আসরে প্রকাশ করেছিলাম।  


একটি অগ্নিতরঙ্গ যখন জ্বলে ওঠে তখন বৃষ্টি এসে সেটা নিভিয়ে দেয়;
কিন্তু বৃষ্টি নিজেই যখন আগুন লাগায় তখন কে সেটাকে নেভাবে ?


শরৎ যদি একটি বাগানকে নষ্ট করে বসন্ত এসে তাতে ফুল ফোটায়
কিন্তু বসন্ত যদি সে বাগান নষ্ট করে তখন সেখানে কে ফুল ফোটাবে ?


আমাকে জিজ্ঞাসা করোনা কিভাবে স্বপ্নের মন্দির ভেঙে গেলো,
তাঁদের জিজ্ঞাসা করো যাদের হৃদয় গিয়েছে ভেঙ্গে ভালোবেসে।


যদি কোনো শত্রূ তোমাকে আঘাত করে তোমার বন্ধু তোমাকে স্বান্তনা দেয়;
কিন্তু যদি তোমার প্রিয়তমা তোমার হৃদয়ে ক্ষত বিদ্ধ করে সেটা কে মুছবে ?


কে জানে কী ঘটতে পারে কাল কে জানে কাল আমি কি করবো ?
তাই মদিরাতে আমি আছি বেঁচে ,বিনা মদিরাতে হবে আমার মৃত্যু।


যদি আমি হই তৃষিত, তাহলে সূরা আমার তৃষ্ণা মেটায় ;
কিন্তু যদি সূরা নিজেই তৃষিত হয় তাহলে তার চাহিদা পূরণ করবে কে ?


একটি নৌকা যদি ডুবে যায় , নাবিক তাকে রক্ষা করে ডাঙায় নিক্ষেপ করে
কিন্তু যদি নাবিক নিজেই নৌকা ডুবায় তখন কে সেটাকে রক্ষা করতে পারে ?


এখানে এটা প্রকাশের উদ্দেশ্য হচ্ছে গজলের মূল অবয়ব টাকে বোঝানোর জন্যে। অর্থাৎ দুই পংক্তি করে একটা স্তবক আর প্রত্যেকটা স্তবক এক একটা 'শের'। এতএব অনেকগুলো শের মিলে তৈরী হলো একটা গজল।


গজল প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত :---
১) সাহিত্য
২)সংগীত


সাহিত্য কাব্যের মূলভূমিকা পালন করে।
এটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত :-
১)তগজ্জুল-- মানব জাতির লৌকিক প্রেম নিয়ে লেখা
২)তসববুফ--অলোকিক প্রেম নিয়ে লেখা। এই কাব্যে থাকবে ঈশ্বরের কাছ থেকে পরম শান্তি লাভ করা।


গজলে বেশি থাকে কথার প্রাধান্য। সুরের বৈচিত্র বিশেষ থাকেনা। ভাষার লালিত্য ও শব্দঝংকার গজলের মূল উপাদান। সঙ্গে ছন্দের মাধুর্য।


গজলের মূল বক্তব্যের মূলধারাটি কি ?
১) নিজেকে ওপরের কাছে ছোট করে অন্যজনকে বড়ো করে দেখানো
২)বাঞ্ছিত প্রেমিক বা প্রেমিকাকে না পেয়ে নিজের জীবনকে ধিকৃত করা
৩)প্রেমিক বা প্রেমিকার দেখা না পেয়ে আকুল হয়ে ভেঙে পড়া
৪)প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজের প্রাণ দেবার সংকল্প করা
৫) দুঃখে সূরাখানায় সূরা পান করে নিমজ্জিত থাকা
৬)প্রেমের স্তুতিতে বিভোর হয়ে পড়া


এগুলো পার্থিব প্রেমের উপকরণ। আবার অন্যদিকে ঈশ্বরের ভক্তিতে প্রেমের প্রকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গজলের বাণীতে।ঈশ্বরের কাছে প্রকাশ করে মান অভিমান,  প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি ইত্যাদি।আসলে গজলের চরিত্র বড়ো কোমল , ভাবপ্রবণ ও সংবেদনশীল।


উপসংহার
'প্রেমের চোখে সুন্দর হোক কালো কি গৌড় বসন
পড়ুক ওড়না রেশমি কিংবা পড়ুক জীর্ণ দীন বসন'
                                                      ----নজরুল  


আজ তবে এই পর্যন্তই থাকে বন্ধুরা!
লেখাটা কেমন লাগলো যদি একটু জানান তবে মনটা ভালো লাগবে।


সবাইকে জানাই বড়দিনের আগাম প্রীতি ও শুভেচ্ছা।