তিরিশের দশকের প্রথম মুসলিম মহিলা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা।কাঁধে ঝুলানো একটি কাপড়ের ব্যাগ, তাতে দু-চারখানা বই বা খাতা।  গভীর মমতা ভরা এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি যেন চোখের সামনে ভাসছে।
তিরিশের দশক মানে মহিলাদের হাজারো সীমাবদ্ধতা, বিধিনিষেধ ও সমাজে নানারকম সীমিতকরণ। সমস্ত বাঁধাকে অতিক্রম করে এই অতি শান্তশিষ্ট প্রকৃতির এই মানুষটি অথচ ভেতরে দ্রোহের আগুন জ্বলা, সেই অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সমাজে প্রচলিত নারীর কারাগার প্রথা তিনি মেনে নিতে পারেন নিই। তাই তো পেলেন দুই শ্রেষ্ঠ কবি নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা, আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা।


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহস করে দেখা করলেন।
শুনুন তাঁর নিজের লেখা জবানবন্দি:-
‘পরিচয়’-এ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে সিদ্দিকা রবীন্দ্রনাথকে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, প্রাপ্তি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাকে লেখেন :


কল্যাণীয়াসু,


আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দুর্বল। যথাসাধ্য সকল কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেওয়ার চেষ্টা করছি।


তোমার কবিতাটি পরিচয়-এর সম্পাদকের কাছে পাঠাই, আশা করি তারা ছাপাবেন, কিন্তু সম্পাদকীয় বিচারবুদ্ধির ওপর আমার কোনো হাত নেই এ কথা নিশ্চিত জেনো। দেখেছি তারা অনেক সময় অনেকের ভালো লেখাকেও বর্জন করে থাকেন; তার পরিচয় পেয়েছি।


ইতি ৩ আশ্বিন, ১৩৪২ শুভার্থী


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :


‘... বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্য্যরে কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্য্যরে কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।’


দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর লিখিত কবিতা ......


'বসন্ত'
আজ কতদিন পরে
বসন্ত আইলো ঘরে
চারিদিক সাজাইয়া
ঢোলবাদ্য বাজাইয়া
ফুলের সাজে আইলোরে
বসন্ত আবার ঘরে
জুঁই বেলি চারিদিকে
বসন্ত মাঝারে থাকে
কচি কচি পাতা ফোটে
বসন্ত বাহার উঠে  


একজন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় এমন একটা কবিতা লিখতে পারেন, এর থেকে তাঁর কবি প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
আবার 'সওগাত'(১৯৩০) এ প্রকাশিত এক কবিতায় বলেন ...
"বসন্ত বিদায়"
বসন্ত উৎসব আজ হয়ে গেছে শেষ
পড়ে আছে বাসি ফুল-মালা
রিক্ত ভূষা উদাসিনী ধরণীর বুকে
জাগে শুধু বুক ভরা জ্বালা


এই অসাধারণ কবিতাটি পড়ুন ..........


'দারিদ্র-মাহাত্ম্য'


জীর্ণ বসনখানি ঢাকিতে পারে না তার দেহ
বাহিরিতে চাহে না লজ্জায়।
আভিজাত্যের কুণ্ঠাভারে নিপীড়িত জন
অন্ধকারে লুকাইতে চায়।
তবুও বাহির হতে হয় শত কাজে
অত্যাচারী সংসারের মাঝে।


পথের পরে
হৃদিস্পন্দ স্তব্ধ করি ধনীর মোটর চলে যায়,
শব্দমান দূরে বহু দূরে।
বক্ষের পঞ্জর টুটি দীর্ঘশ্বাস বাহিরিয়া আসে
আঁধারের কালো বুক চিরে।
পথের দুধারে খাবারের দোকানগুলি
ক্ষুধাতুর ক্ষুধা দ্বিগুণ করিয়া তোলে খালি।


কাজ শেষ হয়
ক্ষুধা ভরা বুকে বলহীন পায়,
আলোহীন বায়ুহীন ঘরে তারে ফিরে যেতে হয়,
সন্ধ্যা আসে, নীলাকাশে, ভেসে ওঠে চাঁদ,
সে জ্যোৎস্না আনে না মোহ, আনে বিস্বাদ,
মর্মাকাশে গর্জে ওঠে তৃষ্ণার্ত রুক্ষ আত্মার।


                       বিশ্বাসহীন রুদ্র হাহাকার—
মনে হয় শ্যেন সম নখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ধরণীরে
আপনার দাবি দিয়ে নিয়ে আসে আত্মার তৃপ্তিরে,
কর হানি কপালেতে কহে বারবার
হে দারিদ্র্য, তোমায় নমস্কার
তোমার মাহাত্ম্য শুধু বনবাসী সন্ন্যাসীর মাঝে—
নহে লক্ষ লক্ষ নরনারী তরে, নহে সংসারের কাজে।


উপরের এই কবিতাটি পড়ে বাকরুদ্ধ হতে হয়।
বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম খ্যাতিমান মহিলা কবি স্বাধীনতার পরে আড়ালে চলে যান। সমাদর ছিল না বলে জীবনের শেষ আট-দশ বছর তিনি সভা-সমাবেশে আসতেন না। ১৯৭৭ সালে তিনি নীরবে নিভৃতে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।


প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি সিদ্দিকা। বাড়িতেই উচ্চশিক্ষিত বাবার কাছে এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন। আর পাঠ নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি থেকে। খুব ছোটবেলায় তিনি মাতৃহারা হন।
কৈশোরে মাতৃবিয়োগ কবি চিত্তকে ব্যথিত ও বিমর্ষ করেছিল।  কবির আত্মমগ্ন চৈতন্যে জুড়ে ছিল মায়ের সুস্থিত উপস্থিতি। মাকে হারানোর বেদনা কবি কখনো বিস্মৃত হননি। ‘অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে ছিলেন বলে কবির চিত্ত বাইরের জগৎকে স্বভাবতঃ আঁকড়ে ধরেছিল। মাতৃহারা হৃদয়ের ক্ষুদ্র বেদনা নিয়ে বাল্য বয়সে কবিতাও রচনা করেছিলেন।’ মায়ের  অভাবে তাঁর শূন্য হৃদয়ের আকুতি:
    ওরা যে কত আনন্দ করে
    কত আর উৎসব ধরে
    আমার হৃদে কিসের উৎসব
    ওদের মত আমার মা থাকিলে
    আমি করিতাম উৎসব


তাঁর নিজের কথায়....


"ছোটবেলা থেকে আমি মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শাসন ছিল না বলেই আমার এক কৃষাণী বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতাম বনে-জঙ্গলে, পুকুর ধারে, বাড়ির পেছনে ছিল বিরাট আমবাগান। সেখানকার পাখির ডাক, বুনোফুল আমাকে মুগ্ধ করত। দুই-এক লাইন করে কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত ‘আনোয়ারা’ গ্রন্থের লেখক মজিবর রহমান। তিনি আমার কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন।"


"আমার মায়ের অনেক বই ছিল। আমি চুপি চুপি সেইসব বই পড়তাম। তা থেকেই আমি জীবন ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হই। বাবার একজন হিন্দু কেরানি আমাকে ‘খোকাখুকু’ ও ‘শিশুসাথী’র গ্রাহক করে দেন। আমার কবিতা লেখার পেছনে বাবার প্রেরণা ছিল।"


‘দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মানসী ও মর্ম্মবাণী, উদয়ন, বসুমতি, প্রদীপ, কিষাণ, অগ্রগতি, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, আজকাল, দীপালি, জয়ন্তী, বঙ্গলক্ষ্মী, উত্তরায়ণ, গুলিস্তান, যুগান্তর, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার [পত্রিকা], বেগম, নবশক্তি, নবযুগ, স্বাধীনতা, নায়ক, সত্যযুগ, পুষ্পপত্র ইত্যাদি পত্রিকায় আমার লেখা বের হয়েছে।’


উপসংহার:-
আমার এই নিবন্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য এই মহান কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাকে বর্তমান প্রজন্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। আর বর্তমান মহিলা কবিদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে।অবহেলিত নারী যখন কুসংস্কার ও সমাজের রক্ষচক্ষুর রোষানলে অন্ধকারে মুক্তির আশায় বড়ই ক্লান্ত তখন তাদের মুক্তির নির্দ্বন্দ্ব বাসনা নিয়ে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আবির্ভাব। কুসংস্কারের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে মুসলিম নারীদের আলোয় বের হয়ে আসার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তিনি পুরোপুরি সমাজ সংস্কারকের তকমা না পেলেও তার কাব্যকীর্তির সৃজন প্রভায় নারী জাগরণ তথা বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্যে একজন  প্রথম মুসলিম মহিলা কবির স্বীকৃতি তারই প্রাপ্য নিঃসন্দেহে।


টিকা:--
জন্ম : ডিসেম্বর ১৬, ১৯০৬
মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র তাঁর কবিতায় প্রানের স্পর্শ লাভ করেছে।  পশারিণী,মন ও মৃত্তিকা এবং অরণ্যের সুর তাঁর কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭৭ সালের ২ মে কবি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আসুন এই মহান মহিলা কবিকে স্মরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।


সংযোগ:-
ওয়েব ডেস্ক