রোমান্টিক কবি জন কিট্স্


জন্ম:  অক্টোবর ৩১, ১৭৯৫
মৃত্যু: ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৮২১)


একরাশ অভিমান আর ব্যথা নিয়ে ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান রোমান্টিক কবি জন কিটস। কিসের ব্যথা আর বেদনা ? দায়ী ছিলেন কিট্স্ এর প্রেমিকা ফ্যানি ব্রাউন??


মনে পরে গেলো সেই নজরুলের কথা.....


"আঘাত করবার একটা সীমা আছে
সেটাকে অতিক্রম করলে
আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে
আর তখন তার নাম হয় অবমাননা। "


কাজী নজরুলের নার্গিস কে লেখা প্রেমের চিঠিগুলো যেভাবে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ , ঠিক একইভাবে কিটস আর ফ্যানি ব্রাউনের প্রেমের গল্প সারা বিশ্বে পরিচিত। তাঁদের প্রেমপত্রগুলি আজও বিশ্ব ইতিহাসের সম্পদ।


কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের চিঠিতে পর্যন্ত্য কিট্স্ ও ফ্যানি ব্রাউনের এর উল্লেখ আছে।


০৮-০৩-২৮


প্রিয় মতিহার


"পরশু বিকালে এসেছি কলকাতা। ওপরের ঠিকানায় আছি। ওর আগেই আসবার কথা ছিল, অসুখ বেড়ে উঠায় আসতে পারিনি। ২/৪ দিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে।"
"সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা। ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে, অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই-ই দাও, কুকুর লেলিয়ে দিওনা।"
"যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু’ফোঁটা অশ্রুর দর্পন দেয়, শুধু আমার নামে।"
"কেবলি কীটস্‌ কে স্বপ্নে দেখছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানি ব্রাউন পাথরের মত।


ভালোবাসা নাও


ইতি
তোমার নজরুল।


কিন্তু কিটস মারা যাওয়ার আগে ফ্যানির সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন। কিটস মৃত্যুর আগে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেভার্নকে বলেছিলেন, “ফ্যানির লেখা চিঠি আমি আর পড়তে পারব না। আমি মারা গেলে আমার বুকের ওপর ওর চিঠি রেখে আমায় কফিন দিও।” কীটসের সেই নির্দেশ পালন করা হয়েছিল। এই নির্দেশ পালন করার ফলে কিটসের প্রেমিকা ফ্যানির শেষ চিঠিতে কী লেখা ছিল তা অজানায় থেকে যায়।প্রেমিকা ফ্যানির হাতে লেখা “গুড নাইট” চিঠি মাথার বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমোতে যেতেন প্রেমিক কবি কিটস। দুশো বছর আগে কিটস- ফ্যানির প্রেমে যেমন ছিল রোমান্স তেমনি ছিল বিচ্ছেদ আর বিতর্ক।


হাম্পস্টেডের এক বাড়িতেই প্রথম আলাপ হয় কিটসের সাথে ফ্যানি ব্রাউনের। কিটস তখন ২২, ফেনি ১৮। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। ফ্যানির সঙ্গে পরিচয়ের দেড় মাসের মাথায় তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন কিটস। ফ্যানি সেই প্রস্তাব মেনেও নেন। দুজনের ‘এনগেজমেন্ট’ হয় গুটিকয়েক আত্মীয়কে নিয়ে। কিন্তু ভাগ্যবিরূপ কিটসের। সেবছরই যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ল কিটসের।এই রোগ ছিল কিটসের কাছে অভিশাপের মত। কারণ, স্কুলে পড়াকালীন সময় কিটসের মা মারা যান এই যক্ষ্মা রোগেই। আর ছোট ভাই টমেরও মৃত্যু হয় একই রোগে। ফলে ডাক্তারির ছাত্র কিটস বুঝেছিলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন কারণ এরোগের চিকিৎসা নেই। ফ্যানি রোজ দেখতে আসতেন অসুস্থ কবিকে। কাঁচের জানালার একপাশে কবি, আর অন্যপাশে কবি- প্রেমিকা। দুজনে চিঠি দেওয়া-নেওয়া হত।


প্রথমজীবনে কিটস গেছিলেন ডাক্তারি পড়তে, তাও আবার সার্জারি। যিনি স্বভাব কবি তার কি ছুরি-কাঁচিতে মন বসে। ক্লাস কামাই করে চলে যেতেন সাহিত্য আড্ডায়। সেখানেই আলাপ হয় তরুণ কবি শেলির সাথে। দুজনে বন্ধুত্ব জমে ওঠে। এছাড়া ঔপন্যাসিক চার্লস ল্যাম্ব, কবি কোলরিজ, উঠতি কবি হ্যামিল্টন, চিত্রশিল্পী সেভার্ন, সাহিত্য সমালোচক হ্যাজলিটের সঙ্গে আলাপ হয়।
এনগেজমেন্টের প্রায় এক বছর দশ মাস পার হয়ে গেলেও কিটসের সুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, শীতের আগেই কিটসকে ইতালি নিয়ে গেলে ভালো হয়। ফ্যানির ইচ্ছা ছিল কিটস ইতালি যাওয়ার আগেই বিয়েটা হয়ে যাক। কিন্তু কিটস জানালো, তাঁর মন সায় দিচ্ছে না।


ইতালি যাবার আগে ফ্যানিদের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলেন কিটস। যাওয়ার আগে কিটস ফ্যানিকে দিয়ে গেলেন প্রিয় বন্ধু জোসেফ সেভার্নের আঁকা কিটসের একটি পোট্রের্ট আর প্রিয় কবিতার বইগুলি।


ইতালিতে মারা যান কিটস। মৃত্যুর আগে ফ্যানিকে কিটস লিখেছিলেন, “আমি এমন কোনো মহান কর্ম পেছনে ফেলে যাচ্ছিনা যা আমার বন্ধুদের গর্বিত করবে, আমি শুধু প্রতিটি জিনিসের ভেতরের সৌন্দর্য্যকে ভালোবেসেছি। সময় পেলে নিজেকে স্মরণীয় করে যেতাম।”
কিটসের অকালপ্রয়াণে ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেলি লিখেছিলেন “Adonais” কাব্য। কবির মৃত্যু সংবাদ খুব শান্তভাবেই গ্রহণ করেছিলেন প্রেমিকা ফ্যানি। কিটসের মৃত্যুর ৬ বছর পর্যন্ত ফ্যানি বিধবার কালো পোশাক পরিধান করেছিলেন, চুল ছেঁটেছিলেন ছোটো করে।’ ফ্যানি দেখতে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, যেকারণে কিটসের মৃত্যুর পর প্রচুর বিয়ের প্রস্তাব পান। অবশেষে কিটসের মৃত্যুর ১২ বছর পর লুই লিণ্ডো নামে এক যুবককে বিয়ে করেন ফ্যানি। অনেকের মতে লুই লিন্ডোর মধ্যে নাকি কিটসের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন ফ্যানি।


ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্য সমালোচকদের কেউ কেউ লিখছেন, “কিটসের অকাল মৃত্যুর পেছনে ফ্যানির অবহেলা ও হৃদয়হীনতা অনেকাংশে দায়ি ছিল। কিটসের যক্ষ্মা ধরা পড়লে তিনি চাইতেন, ফ্যানি তাঁর কাছে থাকুক কিন্তু ফ্যানি তা না করে বিভিন্ন পার্টি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিত। পরপুরুষের সঙ্গে সময় কাটাত। যা কিটসের একেবারে পছন্দ ছিল না। কিটস একটা সময় ফ্যানিকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আর লেখেন একগুচ্ছ ব্যর্থ প্রেমের কবিতা। তারপর একরাশ অভিমান আর ব্যথা নিয়ে চলে যান কবি কিটস।”


টীকা :
❝মানুষ প্রাণপণে প্রাণ বাঁচাতে চায় কিন্তু প্রাণ তো বাঁচে না। সেইজন্যে বাঁচাবার শখ মেটাবার জন্যে এমন কিছুকে সে খুঁজে বেড়ায় যা প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি।❞
রবীন্দ্রনাথ