কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছিলেন
"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে................"


জানিনা শতবর্ষ পরে কজন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়বেন, তবে আমি যে কবি ও কবিতার কথা বলছি তা আজও দুশত বছর পরেও প্রতিটি বাঙালি শিশুর মানসিক বিকাশে অপরিহার্য হয়ে আছে।


কবির নাম মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়।যিনি তাঁর পান্ডিত্যের অলংকারে ভূষিত হয়ে পরবর্তীকালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার নামেই সবাইকার কাছে পরিচিত হন। তাঁর রচিত প্রাথমিক ভাষাশিক্ষা পুস্তক "শিশু শিক্ষা" (১৮৪৯ -১৮৫৩) (তিনটি ভাগে) প্রকাশিত হয় । যদিও বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' (১৮৫৩) বইটি আরো বেশি শিক্ষাপ্রসারে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, কিন্তু মদনমোহন তর্কালংকারের শিশু শিক্ষার ছড়া.........


পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল,
কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।।
রাখাল গরুর পাল, ল'য়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।
ফুটিল মালতী ফুল, সৌরভ ছুটিল।
পরিমল লোভে অলি, আসিয়া জুটিল।।
গগনে উঠিল রবি, লোহিত বরণ।
আলোক পাইয়া লোক, পুলকিত মন।।
শীতল বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর।
পাতায় পাতায় পড়ে, নিশির শিশির।।
উঠ শিশু মুখ ধোও, পর নিজ বেশ।
আপন পাঠেতে মন, করহ নিবেশ।।    


"আমার পণ"


সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
ভাল ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি।
ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।


কবিতাগুলি বিগত দেড়শো বছর ধরে বাঙালির মানসিক গঠনের বুনিয়াদ হয়ে বিরাজ করছে। ভাবতেই ভালো লাগে যে এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর শিক্ষা শুরু করেন এই কবি রচিত শিশুশিক্ষা পাঠ্যপুস্তক দিয়ে ।


যেসময়ে এই কবি জন্মেছিলেন সেই সময়টাকে বাংলার রেনেসাঁ বলা হতো অর্থাৎ নবজাগরণের স্বর্ণযুগ। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলাতে বিল্বগ্রাম এ কবির জন্ম ৩ জানুয়ারী ১৮১৭ সালে।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজ পাঠশালার মাধ্যমে। তারপর একে একে ১৮৪৩-৪৫ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, ১৮৪৬ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ ও ১৮৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন সংস্কৃত কলেজে।
১৮৫৫ সালে শেষ জীবনে এসে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


রসতরঙ্গিণী (১৮৩৪) ও বাসবদত্তা (১৮৩৬) মদনমোহনের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ।
মদনমোহন  সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেশ কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সেগুলির মধ্যে সংবাদতত্ত্বকৌমুদী, চিন্তামণিদীধিতি, বেদান্তপরিভাষা, কাদম্বরী, কুমারসম্ভব ও মেঘদূত প্রধান। কবি-প্রতিভার জন্য  সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি ‘কাব্যরত্নাকর’ এবং পান্ডিত্যের জন্য ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধি লাভ করেন।


১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ  কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


তাঁর সম্বন্ধে আপনাদের কাছে আমার এই সামান্য নিবেদন তুলে ধরতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।