আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি
রেল কাম ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম


নবীন কবি হোন  বা প্রবীণ কবি হোন , ছোট বেলাকার ছড়াগুলো এখনো প্রাণে দোলা দেয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার । ভাবুন তো একবার ছোটবেলাকার ইস্টিশন গুলোর নস্টালজিয়া ? স্টেশন এ গাড়ি থামলো আর শোনা গেলো সেই আওয়াজ --"চায় গরম -গরম চায় " , আর ছুটলাম সেই মাটির কলসিতে খাবার জল ভরতে। আবার সেই স্টিম ইঞ্জিন কয়লার ধোয়া উড়িয়ে চলতেশুরু করলো পু ---উ  ঝিক ঝিক করে। আর স্টেশন মাস্টারের সেই কণ্ঠটি যেন ধ্বনিত হলো কানে :"ইস্টিশনের মিষ্টি গুড় /শখের বাগান গোলাপ ফুল। " তার পরেই কৈশোরে পেলাম পাঠ্য পুস্তকে।.....
শামসুর রাহমান এর ছড়া কবিতা। ....


ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
          রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
          ট্রেনের বাড়ি কই ?


একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
         মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
         ঝন ঝনাঝন ঝন।


দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
         নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
         দিন কেটে যায় বেশ।


থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
        একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
        ঝক ঝকাঝক ঝক।


সেই ছোটবেলার লিমেরিক থেকে শুরু ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম .........তারপর বড়ো হয়ে পেলাম কবিগুরুর রেলগাড়ির সেই অসাধারণ রোমান্টিক কবিতা "হটাৎ দেখা।" রেলগাড়িতে হঠাৎ দেখা হলো গুরুদেবের তাঁর পুরোনো প্রেমিকার সাথে "ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন, আগে ওকে বারবার দেখেছি লাল শাড়িতে, ডালিম ফুলের মত রাঙা’। আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়, আঁচল তুলেছে মাথায়।
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।"


আমাদের জীবন শুরু হয় মায়ের ঘুম পাড়ানি ছড়া দিয়ে। আর সেই মিষ্টি ছড়াগুলো যেন আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে যায় মৃত্যুর দিন পর্যন্ত।  খালি ভাবি আমাদের লং টার্ম মেমোরির কথা। সেই কবেকার ছড়াগুলো এখনো গড়গড় করে বলতে পারি। আর এখন তো অনেক ভালো ভালো ছড়া লেখা হয় , শর্ট টার্ম মেমরি তে তা ধরে রাখতে পারিনা কেন? মনকে কি এখনকার ছড়াগুলো সেভাবে নাড়া দেয় না ?  


যাক সেসব কথা।
ছড়ার মাধ্যমে একসময়ে সহজ উপায়ে বাচ্চাদের ইংরেজি শব্দ শেখানো হতো।
একটি নমুনা ------


"গড্ ঈশ্বর লর্ড ঈশ্বর কম মানে এস
ফাদার বাপ্ ,মাদার মা .সিট্ মানে বস।
ব্রাদার ভাই ,সিস্টার বোন , ফাদার সিস্টার পিসি ,
ফাদার-ইন-ল মানে শ্বশুর, মাদার সিস্টার মাসি।
আই মানে আমি আর ইউ মানে তুমি ,
আস মানে আমাদিগের , গ্রাউন্ড মানে জমি।
ডে মানে দিন আর নাইট মানে রাত .
উইক মানে সপ্তাহ ,রাইস মানে ভাত।
পম- কিম লাউকুমড়া কোকোম্বার শশা .
ব্রিনজেল বেগুন আর প্লোম্যান চাষা।


অতীতে বাঙালি শিশুর অঙ্ক কষা, হিসাব শেখানো সবই হতো মুখে মুখে ছন্দে বা পয়ারে। এদের বলা হত আর্যা। এই আর্যাগুলোকেই বলা হয় ছড়ার আদি রূপ।  

ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
চাম কাটে মজুমদার ।
ধেয়ে এল দামোদর ।
দামোদরের ছুতোরের পো
হিঙুল গাছে বেঁধে থো ।
হিঙুল করে কড়মড়-
দাদা দিলে জগ্ননাথ ।
জগ্ননাথের হাঁড়িকুড়ি
দুয়ারে বসে চাল কাঁড়ি ।
চাল কাঁড়তে হলো বেলা
ভাত খাও সে দুপুরবেলা
ভাতে পড়ল মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁছি ।
কোদাল হল ভোঁতা
খাঁ ছুতোরের মাথা ।


ছড়ায় সত্য ঘটনার দু-একটি ভাঙা টুকরোও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।


এই চামকাটা মজুমদার হলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার। সে সময়ে দিল্লির সম্রাট ছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। সেখান থেকেই তিনি সে সময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতেন বারোজন শাসক কে নিয়ে । বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত এঁৱা। এই বারো ভূঁইয়ারা একসময় একজোট হয়ে দিল্লির শাসন মানতে অস্বীকার করেন। স্বাধীন রাজার মতো রাজত্ব করতে থাকেন তাঁরা।এই বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। মানসিংহকে সহযোগিতা করে  ভবানন্দ মজুমদার একা দেশদ্রোহ করে মানসিংহকে সহযোগিতা করেছিলেন। মানসিংহ এবং মোগল সৈন্যদের অসংখ্য নৌকা জোগাড় করে দিয়ে দামোদর নদ পার করান তিনি।ওপরের ছড়াটির আপাত অর্থহীন কথার মধ্যে যা পাওয়া যায় তা হলো, ভবানন্দের বিশ্বাসঘাতকতা। ছড়াটিতে ঘৃণাবশত ভবানন্দের নাম উল্লেখ না করে তাকে চামার বা চামকাটা মজুমদার বলা হয়েছে।
এটাতো গেলো কবিতার পশ্চাৎপট যা বড়ো হয়ে জেনেছি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে ডাউন মেমোরি লেন যা দোলা দিয়ে যায় আজও মনের মধ্যে।
গোল হয়ে বসে আঙ্গুল গুলো পেতে বসা আর ছড়াটি পড়তে থাকা।
"কোদাল হল ভোঁতা
খাঁ ছুতোরের মাথা"
যার আঙুলে শেষ হলো 'মাথা' দিয়ে সেই আঙুলটি আউট।


এবারে চলো খেলা যাক আবার হাটু পেতে বসে সেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছড়া 'একদম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে'


আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক ঢোল মৃদং বাজে
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি,
ঢুলি গেল কমলাফুলি
কমলাফুলির টিয়েটা,
সূর্যিমামার বিয়েটা।


ছড়াটিতে ডোম সৈন্যদের শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।আগডুম অর্থ যে ডোম সৈন্য সবার আগে যায়। আর ঘোড়াডুম হলো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ডোম সৈন্য। সঙ্গে বাজে তিন ধরনের বাদ্য—ঢাক, মৃদং এবং ঝাঝর। এই বাদ্যগুলো বাজানো হয় শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার সময়। তাই প্রথম দুই ছত্রে মল্লবাজদের ডোম সৈন্যের কথা হয়তো মনে পড়া স্বাভাবিক। মধ্যযুগের ধর্মমঙ্গলেও ডোম সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।


এবার আসুন মায়েদের ছেলে ভুলানো ছড়াগুলির দিকে একটু নজর দেয়া যাক ।


খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুল, পান ফুরুল
খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।


একসময় বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ।  তাঁর শাসনা কালে বাংলায় শুরু হয়েছিল লুটেরা বর্গীদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ। মারাঠা যোদ্ধাদের ফারসিতে বলা হতো বারগিস।  লোকেমুখে হয়ে দাঁড়ায় বর্গী।  এই মারাঠা দস্যু বা বর্গীরা পশ্চিমবঙ্গ ও মুর্শিদাবাদে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল। তাদের কথাই উঠে এসেছে এই ছেলে ভোলানো ছড়াটিতে। এ ছাড়া এখানে ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে’ কথাটা বলা হয়েছে। সম্ভবত ধান চাষের ক্ষতি অথবা বর্গীদের লুটতরাজ প্রসঙ্গে। এমন অরাজক অবস্থায় কৃষকদের পক্ষে খাজনা দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সে কথাই বলা হয়েছে ছড়াটিতে।


ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি।..........


ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি,
মোদের বাড়ি এসো।        
খাট নাই পালং নাই,      
চোখ পেতে বোসো।        


বাটা ভরা পান দেব,      
গাল ভরে খেও।            
খোকার চোখে ঘুম নাই,    
ঘুম দিয়ে যেও।


Aunties who put us to sleep
Come to our house
There's no bed and no mattress
Sit on the eyes*.


We'll give you a "bata" full of "paan"
Eat mouthfuls
There's no sleep in "khoka's" eyes
Give some sleep before you go.


এমন ছড়া গানের চিরায়ত কথাগুলো আজও মায়েদের মুখে মুখে ফেরে। অনেক কথাই পালটে ফেলতে হবে আজ এই ছড়া নতুন করে লিখতে গেলে।  আজ খাট-পালংয়ের অভাব না হলেও দিন দিন ছোট হয়ে আসা একক পরিবারে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিরাই বিরল। কিন্তু শিশুকে সময়মতো ঘুম পাড়াতে হবে। কেননা শিশুর জন্য ঘুম খুবই জরুরি।


আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ
এতো ডাকি তবু কথা
কওনা কেন বৌ ?


নোটন নোটন পায়রাগুলি


নোটন নোটন পায়রাগুলি
ঝোটন বেঁধেছে।
ওপারেতে ছেলেমেয়ে
নাইতে নেমেছে।
দুই ধারে দুই রুই কাতলা
ভেসে উঠেছে।
কে দেখেছে কে দেখেছে
দাদা দেখেছে।
দাদার হাতে কলম ছিল
ছুঁড়ে মেরেছে।
উঃ বড্ড লেগেছে।


আয়রে আয় টিয়ে


আয়রে আয় টিয়ে,
নায়ে ভরা দিয়ে,
নায়ে নিয়ে গেল বোয়াল মাছে,
তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে।
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা,
খোকার নাচন দেখে যা।


খোকন খোকন ডাক পাড়ি


খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন মোদের কার বাড়ি?
আয়রে খোকন ঘরে আয়,
দুধমাখা ভাত কাকে খায়।


উপসংহার : ওপরের এই প্রচলিত ছড়াগুলো আজ ও মনে দোলা দিয়ে যায়। নস্টালজিয়া ধরনের এক অনুভূতি যেন। ছোট বেলার বাংলা বই এর সেই ছড়াগুলো মুখস্থ করার দরকার হতোনা। সেই কবিতা যা পরলে ছোট বেলার সেই সৃতি গুলো মনে পড়ে যায় আর আপনাআপনি সেই ছোট বেলাকার কথাগুলো মনে পড়ে যায়।অনেক চেষ্টা করেও এই ছড়াগুলোর লেখক বা লেখিকার নাম সংগ্রহ করতে পারলাম না। যদি কারুর জানা থাকে জানালে জানার পিপাসা মিটবে।


টিকা : আমার এই লেখাটি তখনি সার্থক হবে যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, নতুবা নয়।  


ভালোবাসায় ভালো থাকুন সবাই।