পরকীয়া বিয়াত্রিচে কে ভালোবেসে সৃষ্টি হলো মহাকবি দান্তে'র মহাকাব্য 'ডিভাইন কমেডি' (The Divine Comedy)


ইতালিও কবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি :-
ইতালিও ভাষায় "দিভিনা কোম্মেদিয়া"
ইংরেজী অনুবাদ 'ডিভাইন কমেডি' (The Divine Comedy)
'ডিভাইন কমেডি নামেই এই কাব্য বিশ্বে সুপরিচিত।
এর বাংলা করলে দাঁড়ায় "দ্ব্যর্থতা নিরসন"।
বাংলা ভাষা সহ পৃথিবীর আরো অনেক ভাষায় এ মহাকাব্য অনূদিত হয়েছে।


প্রথমে সংক্ষেপে তাঁর জীবনের গুটিকতক কথা এখানে উল্লেখ করছি। ইতালির শ্রেষ্ট মহাকবি দান্তে এলিঘেরি'র সম্পর্কে নতুন করে বিশেষ কিছু বলার নেই, কারণ কবি দান্তের নাম সবাই জানেন। দান্তে যে শুধুমাত্র কবি ছিলেন তাই নয়, আমাদের নজরুলের মতো ছিলেন দার্শনিক, রাজনীতিবিদ,এবং যোদ্ধা। ছয় বছর বয়সে মাতা কে ও আঠারো বছর বয়সে পিতাকে হারান।


এই মহাকাব্যে পরকীয়া প্রেম ই পবিত্র দ্বীপশিখার মতো মানবাত্মাকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ।তাই 'ডিভিনা কমেডিয়া' কাব্যে তে বিয়াত্রিচে কবিকে দেখা দেন নরকের দ্বার হয়ে নয়, স্বর্গের পথনির্দেশিকা হয়ে। এ এক  শুদ্ধতম ভালোবাসা অর্থাৎ প্লেটোনিক ভালোবাসা। শুধু আবেগ দিয়ে  কামগন্ধহীন এ ভালোবাসা। এ ভালোবাসা বায়বীয়। এই কাব্যের নায়িকা বিয়াত্রিচে। তাকে বিবাহ করার প্রশ্ন নেই, কারণ তিনি ছিলেন অপরের নারী। দুজনেরই মৃত্যু ঘটেছিলো অল্পবয়সে। তা যদি নাও ঘটতো, কবির জীবনে মিলনের কোনো আশা ছিলোনা। তাঁদের ভালোবাসার মধ্যে ছিল মধ্যযুগের স্বপ্নসুন্দর উচ্চাঙ্গ প্রেমের প্রভাব ও মুক্ত মানবিক চিন্তার।  


এবারে আসা যাক শিরোনামের মূল বক্তব্যতে।


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কি বলেন ?
'বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য'-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


" এই স্বপ্নময় কবির জীবন গ্রন্থে বিয়াত্রিচেই তাঁর জীবন-কাব্যের নায়িকা! বিয়াত্রিচেকে বাদ দিলে তাঁর কাব্য পাঠ করা বৃথা।বিয়াত্রিচেই তাঁহার জীবন-কাব্যের নায়িকা!  বিয়াত্রিচেকে বাদ দিলে তাঁর জীবন-কাহিনী শূন্য হয়ে পড়ে। কবির জীবনের দেবতা ছিল বিয়াত্রিচে।তাই তাঁর  সমস্ত কাব্যজুড়ে বিয়াত্রিচের স্তোত্র। বিয়াত্রিচের প্রতি প্রেমই দান্তের প্রথম কবিতার উৎস। কবির প্রথম গীতিকাব্য "ভিটা নুওভা'র (Vita Nuova) প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচেরই আরাধনা।দেবতার ন্যায় চিত্রিত করেও কবি দান্তে পরিতৃপ্ত নন ।"


"এই কাব্যের শেষ ভাগে তিনি লিখলেন ......


"এই পর্যন্ত লিখিয়াই আমি এক অতিশয় আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিলাম-- সেই স্বপ্নে যাহা দেখিলাম তাহাতে এই স্থির করিলাম যে, আমি সেই প্রিয় দেবীর বিষয় যাহা লিখিতেছি তাহা তাঁহার যোগ্য নহে-- যে পর্যন্ত ইহা অপেক্ষা যোগ্যতর কবিতা না লিখিতে পারিব সে পর্যন্ত আর লিখিব না। ইহা নিশ্চয়ই যে, তিনি (বিয়াত্রিচে) জানিতেছেন, আমি তাঁহার বিষয়ে যোগ্যতর কবিতা লিখিবার ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি। সমুদয় জীবের প্রাণদাতা ঈশ্বর-প্রসাদে আর কিছুদিন যদি বাঁচিয়া থাকি, তবে তাঁহার বিষয়ে এমন লিখিব, যাহা এ পর্যন্ত কোনো মহিলার সম্বন্ধে কেহ কখনো লেখে নাই।' এই স্থির করিয়াই তিনি তাঁহার মহাকাব্য "ডিভাইনা কামেডিয়া' (Divina Commedia) লিখেন ও বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে এমন কথা বলেন, যাহা কোনো মহিলা সম্বন্ধে কেহ কখনো বলে নাই।"


"রূপক প্রভৃতির দ্বারা বিয়াত্রিচেকে দান্তে এমন একটি মেঘময় অস্ফুট আবরণে আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন যে, পাঠকের চক্ষে সেই অস্ফুট মূর্তি অতি পবিত্র বলিয়া প্রতিভাত হয়। দান্তে তাঁহার প্রেমার্দ্র হৃদয়ে মনে করিতেন, ‘যে ব্যক্তিই বিয়াত্রিচের নিকট আসিত তাহারই হৃদয়ে এমন গভীর ভক্তির উদ্রেক হইত যে, তাহার মুখের দিকে নেত্র তুলিতে তাহার সাহস হইত না।’ দান্তে বলেন, ‘যখন মনুষ্যেরা তাঁহার দিকে চাহিত তখনি তাহারা কেবল একটি মাধুর্য ও মহত্ত্ব অনুভব করিত।’ দান্তে ভক্তির চক্ষে দেখিতেন, সমস্ত পৃথিবী বিয়াত্রিচের পূজা করিতেছে, দেবতারা তাঁহাকে আপনাদের মধ্যে আনিবার জন্য প্রার্থনা করিতেছেন।"
" যাঁহারা যাঁহারা প্রেমের অধীন আছেন তাঁহাদের বন্দনা করিয়া ও তাঁহাদের এই স্বপ্নের প্রকৃত অর্থ-ব্যাখ্যা করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া এই স্বপ্নের বিষয়ে একটি কবিতা লিখিব স্থির করিলাম।


প্রেম-বন্দী হৃদি যাঁরা, সুকোমল মন,
যাঁরা পড়িবেন এই সংগীত আমার,
তাঁরা মোর অনুনয় করুন শ্রবণ,
বুঝায়ে দিউন্‌ মোরে অর্থ কী ইহার?
যে কালে উজ্জ্বল তারা উজলে আকাশ,
নিশার চতুর্থ ভাগ হয়ে গেছে শেষ,
প্রেম মোর নেত্রে আসি হলেন প্রকাশ,
স্মরিলে এখনো কাঁপে হৃদয় প্রদেশ!
দেখে মনে হল যেন প্রফুল্ল আনন;
মোর হৃদ্‌পিণ্ড রহে করতলে তাঁর;
বাহু-‘পরে শান্ত ভাবে করিয়া শয়ন
ঘুমাইয়া রয়েছেন মহিলা আমার-
অবশেষে জাগি উঠি, প্রেমের আদেশে
সভয়ে জ্বলন্ত-হৃদি করিলা আহার!
তার পরে চলি গেলা প্রেম অন্য দেশে
কাঁদিতে কাঁদিতে অতি বিষণ-আকার!


দান্তে ও বিয়াত্রিচে'র সংক্ষেপে বিশেষ ঘটনা ও বিশেষ বিবরণ


দান্তে ও বিয়াত্রিচের দুজনার জন্মই ইতালির ফ্লোরেন্সে ১২৬৫ সালে। দান্তে কয়েকমাসের বড় ছিলেন। দুজনের প্রথম দেখা হয় যখন তাদের বয়স ছিল ৯ বছর। দান্তে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন ৫৫ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৩২১ সালে। বিয়াত্রিচের পুরো নাম বিট্রিস "বাইস" ডি ফোলকো পোর্টিনিরি।মাত্র ২৫ বছর  বয়সে বিবাহের ঠিক তিন বছর পরে তার মৃত্যু হয় ১২৯০ সালে। যিনি দান্তে আলিঘেরির ভিটা নুভা এর মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
যাঁকে উদ্দেশ্য করে 'ডিভাইন কমেডি' রচিত হয়েছিল সেই বিয়াত্রিচের সঙ্গে দান্তের সারা জীবনে দেখা হয় মাত্র দুবার। প্রথম যখন তাদের মধ্যে দেখা হয় তখন দুজনারই বয়স মাত্র ৯ বছর। দান্তের কথা অনুযায়ী তাকে দেখা মাত্রই তিনি তাঁর প্রেমে পড়েন ও বিয়াত্রিচে'র মধ্যে কেমন যেন এক দৈব শক্তির অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ও উদ্বিগ্ন করে। আগামী ৯ বছর তিনি তাকে মনে মনে ভালোবাসেন যে কথা বিয়াত্রিচে কোনোদিন জানতেও পারেননি। ঠিক আরো ৯ বছর বাদে কোনো একদিন বিয়াত্রিচে সাদা পোশাক পরে দুই বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছিলেন তখন দান্তে কে দেখতে পেয়ে তাঁকে মাথা নত করে অভিবাদন করেন। তাতে দান্তে অভিভূত হয়ে পড়েন ও ছুটে বাড়ির দিকে চলে যান ও তাঁর নিজের কক্ষে প্রবেশ করে শুধু এই ঘটনার কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পরেন ও এমন একটি স্বপ্ন দেখেন যে স্বপ্নের বিষয় ফুটে উঠেছে তাঁর 'লা ভিটা নোভা' (নবজাগরণ) কাব্য গ্রন্থে। এরপরে তিনি শুরু করেন 'ডিভাইন কমেডি'। তিনটি খন্ডে রচিত হয়েছিল এই কাব্য।গ্রন্থটি গল্প ও কবিতার সংমিশ্রণ। এই গ্রন্থে নরকের বর্ণনা আছে অতি শৈল্পিকভাবে।ডিভাইন কমেডি একটি রূপক কাহিনী। হৃদয়ের আবেগ, নিখুঁত বর্ণনা,দার্শনিক চিন্তা এবং ইতিহাস ও পুরাণের সুন্দর ও অপূর্ব মিশ্রনের ফলে কাব্যটি সর্বকালের একটি মহাকাব্য হয়ে কালজয়ী হয়ে বিরাজ করছে।আর এই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র বিয়াত্রিচে। পৃথিবীতে ভালোবাসার যেসব বাস্তব কাহিনী আছে, তাদের মধ্যে দান্তের এ কাহিনী বিস্ময় জাগায় মনে।


১৪২৩৩ লাইনের এই মহাকাব্য এইভাবে বিভক্ত :-
১) ইনফেরনো
২)পুরগাটেরিও
৩)পারাদিসো


২০ বছর বয়স থেকে তিনি শুরু করেন বিয়াত্রিচে কে নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করা। বিয়াত্রিচের মৃত্যুর পরেও দান্তে কোনোদিন তাঁকে ভুলতে পারেননি।


উপসংহার :-
বিশ্বের দরবারে আবার নতুন করে বাঙালির সোনালি অতীতকে স্বীকৃতি এনে দিয়ে বাঙালিকে নিয়ে গেলেন আরো এক গর্বের জায়গায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাত-জামাই  শ্যামল কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। টানা ১৬ বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় ডিভাইন কমেডির অনুবাদ সম্পূর্ণ করে ইতালীয় সাহিত্যের 'লরেল অব দান্তে' সম্মান পেলেন।  ইতালিতে দান্তের সমাধির পাশে উচ্চারিত হল বাংলায় ডিভাইন কমেডি। ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে কলকাতার চিৎপুর রোডের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মধ্যে যেন তৈরী হলো নবজাগরণের সেতুবন্ধন।


টিকা:
এছাড়া .................


দান্তে রচনা সমগ্র(ডিভাইন কমেডি)
অনুবাদ: সুধাংশু রঞ্জন ঘোষ্


'দান্তে ও বিয়াত্রিচে' - নারায়ণ সান্যাল


'বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য'-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/15886]


আমার এই নিবন্ধে যাদের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করেছি ও সাহায্য নিয়েছি .....


ওয়েব ডেস্ক
https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/15886]
বিভিন্ন উইকিপিডিয়া থেকে ও নানান কিছু বই ঘেটে