তোর হাতে কলম, কবি লেখ রে লেখ.....................
কবিরা যদি তাঁদের সদিচ্ছাগুলো লেখনীর মাধ্যমে  সমাজের কাছে তুলে না ধরতে পারেন , তাহলে সব লেখনী হয়ে যাবে কাপুরুষতার আঙিনায় হত্যার সামিল। কলমকে শিকারের বল্লম হিসেবে ভেবে কবিতাকে তুলে দিতে হবে পাঠকদের কাছে, সমাজের কাছে । কবি বাস করেন সমাজের বহুত্বের ভেতর। তাই তিনি যেমন নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ, ঠিক একই ভাবে দায়বদ্ধ সমাজের কাছে।কবির ব্যক্তিত্ব সমাজের সঙ্গে একটা বন্ধনের সৃষ্টি করে, তাই কবি কখনো আত্মকেন্দ্রিক, জীবনবিমুখ হতে পারেন না। তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন সত্য সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি। সমাজের উপকার এবং সমাজকে কলুষমুক্ত করাই শিল্পী-সাহিত্যিকদের কর্তব্য।কবির দায়বদ্ধতা যদি শুধু 'আর্ট ফর আর্ট সেক' ,অর্থাৎ কবিতার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে জড়িয়ে থাকে, তাহলে কবির অন্তরের প্রেরণা, অন্তরের বিশ্বাস শুধু কবিতা শিল্পের প্রতি একটা কমিটমেন্ট এর মতো হয়ে যাবে, সমাজের কোনো কাজে লাগবেনা।তাই কবিদের উচিত কবিতাকে 'আর্ট ফর আর্ট সেক' না বানিয়ে ‘আর্ট ফর লাইফস সেক' বানানো ।  


কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তাই লিখলেন ..........
‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা
তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা
বড় কথা বড় ভাব আসে নাকো মাথায়,
বন্ধু বড় দুঃখে’ অমর কাব্য তোমরা লিখিও,
বন্ধু, যাহারা আছো সুখে
.. প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখা তাদের সর্বনাশ’।


.কবিতাকে 'আর্ট ফর আর্ট সেক' না বানিয়ে ‘আর্ট ফর লাইফস সেক' বানালেন ।  একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।  সত্য-সুন্দরের বাণী উচ্চারণের সাথে সাথে সমাজের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ বঞ্চনার ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কবি রচনা করেছেন এই কবিতা।একাধারে কবিতার নান্দনিকতা ধরে রাখলেন ,অন্যদিকে উজ্জীবিত করলেন সমাজকে ।


রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঠিক নজরুলের মতো প্রতিবাদী উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায় না। তবুও তার সূক্ষ্ম ও শালীন প্রতিবাদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
উদাহরণ :-
‘আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে,
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’,


আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কি যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথাকুটে’


‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছো অপমান
অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছো যারে
সম্মুখে দাঁড়িয়ে রেখে তবু কোলে দাওনা স্থান
অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান’।


কবির লেখনীতে স্বদেশভাবনার জাগরণ থাকতে হবে, কালের স্পর্শ থাকতে হবে। কালের প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া মহৎ সাহিত্যিকের কাজ নয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক আবহে ক্রান্তিকাল উত্তরণের জন্য যে সব সাহিত্যকর্ম সৃজিত হয়েছে সেগুলোতে একদিকে যেমন স্বদেশ ভাবনা ও কালের স্পর্শ ছিল অন্যদিকে সে সব সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হয়েছে।


তাই একজন লেখক তাঁর সাহিত্য কর্মকে কেবল মনীষার বাহনরূপে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বের প্রকাশ মাধ্যম রূপে, সমাজ চৈতন্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিমা রূপে দেখতে হবে। লেখককে অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে হবে, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে। এ কথা সত্য যে, সুন্দরের শাশ্বত ডাকে লেখকের সৃজন তিয়াসী মন যতই ব্যাকুল থাকুক, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি রয়েছে তাঁর স্বতঃসিদ্ধ অঙ্গীকার, রয়েছে অনেক দায়বদ্ধতা। একজন লেখককে শুধু সুন্দরের রচনায় পারঙ্গমতা দেখালে চলবে না। জীবন ধারণের, জীবন সংরক্ষণের জন্য তাঁকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। চিন্তাজীবী লেখক শিল্পকলার সব শাখাতে বিচরণ করে সোচ্চার হোন সমাজের জন্যে । নিজের ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যান। আসুন আমরা কবিরা কলমের শাণিত আঘাত হেনে জেগে উঠি সমাজের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে।


উপসংহার :-
"তোর হাতে কলম, কবি লেখ রে লেখ
তুই-ই আজকে জাতির প্রহরী, তার বিবেক
সেই লেখা পড়ে,পাঠক , তুইও ভাবতে শেখ
সেই লেখা পড়ে , হে মানুষ,তুই জাগতে শেখ"
                                    ------------------মন্দ্রাক্রান্তা সেন  


টিকা:
কবি ও কবিতা কি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ? আপনি কি ভাবছেন ?