চলুন আজ আপনাদের নিয়ে যাবো বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর চারশো বছরের পুরাতন শিব মন্দির দর্শনে ,যে শিব মন্দিরের প্রত্যেকটা ইটের ভাজে ভাজে জড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের করুন প্রেমের কাহিনী। যেখানে চন্দ্রাবতী রচনা করেছিলেন একাধিক পালা যা পরে 'ময়মনসিংহ গীতিকা' নামে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। করলেন রামায়ণ রচনা।


ময়মনসিংহের বিখ্যাত আর কি আছে জানা নেই, তবে দুটো জিনিস আমার মনে সারাজীবনের মতো
হৃদয়ে গেথে আছে।


ভোলা ময়রার সেই বিখ্যাত কবিগানের প্রথম লাইন দুখানি ...


"ময়মনসিংহের মুগডাল, খুলনার ভালো খই
ঢাকার ভালো পাতক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।"


আর তারপরেই প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ও চারশো বছরের পুরাতন চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত শিব মন্দির।
মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী এক কিংবদন্তি।


স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী আত্মপরিচয় দিলেন ......


"ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায় ।।
ভট্টাচার্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।(অঞ্জনা - তাঁর মায়ের নাম)
বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাওনি।
--------------------------------------------------
"বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তার ঘরে জন্ম নিলো চন্দ্রা অভাগিনী।
সদাই মনসা-পদ পুঁজি ভক্তিভরে
চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে।"
--------------------------------------------------


জন্ম ও পরিবার ......
পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য (দ্বিজ বংশীদাস)। মাতার নাম অঞ্জনা। চন্দ্রাবতীর জন্ম ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে 'পাতুয়ার' গ্রামে। কবি চন্দ্রাবতী,গবেষকদের মতে আজ অবধি সংগৃহিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি।


এই কিশোরগঞ্জ কে বলা হয় বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী। বাংলার প্রথম সার্থক এই মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়াইর গ্রাম। পাশে বয়ে যেত ফুলেশ্বরী নদী, আদর করে লোকে ডাকতো ফুলিয়া নদী। আজ যেমন কবি মাইকেল মধুসূধনের 'কপোতাক্ষ' নদী শুকিয়ে গেছে, ঠিক একইভাবে কবি চন্দ্রাবতীর 'ফুলেশ্বরী' নদীও শুকিয়ে গেছে। শুধু কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির। কবি চন্দ্রাবতীর অমর প্রেমের স্মৃতি মিশে আছে শিব মন্দিরকে ঘিরে। চন্দ্রাবতী ছিলেন এক অনিন্দসুন্দরী মহিলা। শৈশবের বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ। রোজ সকালবেলায় দুই বন্ধু মিলে যেতেন পূজার ফুল তুলতে। ক্রমে ক্রমে দুইজনে বড় হতে লাগলেন আর বন্ধুত্ব পরিণত হলো প্রণয়ে। স্থির হলো দুজনের বিয়ে হবে। বিবাহের সব আয়োজন সম্পূর্ণ। কিন্তু এমন সময় জয়ানন্দ হটাৎ এক মুসলিম মেয়ের(আসমানি) রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকেই বিয়ে করবেন বলে স্থির করলেন। খবর পৌঁছলো চন্দ্রাবতীর কাছে। কান্নায় ভেঙে পড়লেন চন্দ্রাবতী। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। পিতা মেয়ের এই অবস্থা দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। মেয়েকে উপদেশ দিলেন শিবের উপাসনা করতে ও রামায়ণ রচনা করতে। তৈরী করে দিলেন তাদেরই মনসা মন্দিরের পাশে একটি শিব মন্দির। চন্দ্রাবতী নিজেকে শপে দিলেন শিবের চরণে।


এভাবেই দিন যেতে লাগলো। কোনো এক সময়ে জয়ানন্দের ভুল ভাঙলো।চন্দ্রাবতীকে একটি পত্র লিখলেন ..
শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই
------
শিশু কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের মালা
তোমারে দেখিতে মন হইয়াছে মন উতলা
-------------
ভালো নাহি বাস কন্যা এ পাপিষ্ট জনে
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে
একবার দেখিয়া তমা ছাড়িব সংসার
কপালে লিখেছে বিধি মরণ আমার ।


পত্র পড়ে চন্দ্রাবতীর ব্রম্ভচর্য,অবিচলিত সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। অশ্রুসিক্ত বদনে তিনি পিতার কাছে বিধান চাইলেন। মেয়ের মানসিক শিথিলতা মেটাতে বংশীদাস তাকে স্বান্তনা দিলেন ...
তুমি যা লইয়াছ মাগো সেই কাজ কর
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর


জয়চন্দ্রকে পত্র দ্বারা নিষেধ করে চন্দ্রাবতী যোগাসনে বসে মনের সমস্ত অৰ্গল রুদ্ধ করলেন,তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেলো। শিব ধ্যানে আত্মহারা হয়ে তিনি সমস্ত জাগতিক জ্ঞান লুপ্ত হলেন।    


শিব মন্দিরে ফিরে এলেন চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে জয়ানন্দ । অনেক্ষন ধরে ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে। চন্দ্রাবতী তখন ধ্যানে মগ্ন । জয়ানন্দের উপস্থিতি তার কাছে পৌঁছলো না। মন্দিরের দরজা খোলা না পেয়ে মন্দিরের দরজায় সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে লিখলেন এক চার লাইনের কবিতা .......
'শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ট জানিয়া মোর হৈলা সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জন্মের মতো'
জয়ানন্দ আত্মগ্লানিতে ভুগে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।  


তাঁর রচিত ‘দস্যু কেনারাম’, ‘মলুয়া পালা’ এবং ‘রামায়ণ’সহ অজস্র কবিতা ও লোক-সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে চন্দ্রাবতীর বিস্ময়কর কাব্য-প্রতিভার পরিচয় মেলে । তাঁর কবিতা ও তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এমন উচ্চমানে পৌঁছে দিয়েছে তা বিস্ময় জাগায় মনে। কবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের এক ট্র্যাজিক নায়িকা। রোম্যান্টিক মনের অধিকারী চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় ‘চন্দ্রাবতী পালা’য়। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এ লোকগাথা চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক একমাত্র লিখিত দলিল।
১৯১৬ সালে ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম সেই এলাকার প্রচলিত পালা গান বা গাথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন।আচার্য্য দীনেশ চন্দ্র সেনের উৎসাহে তা পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত পালা ময়মনসিংহ গীতিকা নামেই পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৬ সাল নাগাদ ক্ষিতিশ মৌলিক একটি সম্পাদিত রূপ প্রকাশ করেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কে অনেকে অসমাপ্ত ও দুর্বল সাহিত্য রচনা বলে সরিয়ে রেখেছিলেন। শ্রদ্ধেয়া সাহিত্যিক নবনিতা দেবসেন চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ পাঠ করে বিস্মিত হয়ে বলেছেন, এ রচনাটি দুর্বল তো নয়ই, এটি অসমাপ্তও নয়। এ রচনাটিতে রামের জয়গান না করে তিনি সীতার দুঃখ দুর্দশার দিকটাই বেশি করে তুলে ধরেছেন , যা তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে।  নবনিতা দেবসেন চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদের কাজটিও সম্পন্ন করেছেন। (প্রসঙ্গত, কবি ও সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন পুরো রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন,যা বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয় )।


উপসংহার :-
চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণের পান্ডুলিপিটি বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। অনাদি ভবিষ্যতের কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক হয়তো সেই প্রাচীন পান্ডুলিপিটি ঘেঁটে নবরূপে আবিষ্কার করবে বাংলা সাহিত্যের এই প্রথম নারী কবিকে।রামায়ণের এ নবতর রূপ-কল্পনা করতে গিয়ে তিনি নিজস্ব শিক্ষা এবং রুচি অনুসারে রামায়ণের চিরাচরিত বহু বিষয়কে যেমন বিমুক্ত করেছেন, তেমনি বহু নতুন বিষয়কে সংযুক্ত করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং জীবনাদর্শকে জারিত করে সেটিকে রামায়ণের গতানুগতিক ধারার সাথে সম্পৃক্ত করে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক ব্যতিক্রমী রচনা যা প্রকৃত অর্থে রামায়ণের মোড়কে সীতায়ণ! সেই হিসেবে, চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।


টিকা:-
পূজা শেষে মন্দিরের দরজা খুলে চন্দ্রাবতী জয়ানন্দের লেখাটি দেখতে পান। মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ সে লেখা মুছে ফেলার জন্য তিনি নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন নদীর জলে ভাসছে জয়ানন্দের মৃতদেহ। মুহূর্তে তাঁর জীবনের সব আলো নিভে যায়। জয়ানন্দের মৃত্যু থামিয়ে দেয় চন্দ্রাবতীর জীবন। প্রাণের আবেগ সম্বরণ করতে না পেরে প্রন্মত্তা-ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়ানন্দের শেষযাত্রায় তিনিও সঙ্গী হন। এভাবেই চন্দ্রাবতী তাঁর প্রেমকে অমর করে রেখে গেছেন।


মন্তব্য:-
যারা আমার এই লেখাটি কষ্ট করে পড়লেন তাদের আমার অন্তর থেকে ভালোবাসা ও ধন্যবাদ জানাই।যদি আসরের কবিদের কবি চন্দ্রাবতী'র সম্বন্ধ্যে আরো কিছু তথ্য জানা থাকে তাহলে তাদের স্বাগতম জানাই।আর আমার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলি কবিতাকে অন্যান্য শিল্পের মত বিমূর্ত করার প্রক্রিয়া এভাবেই বিকশিত করে তুলুন।


সংযোগ স্থাপন :
এই লেখাটি লেখার জন্যে বিস্তর ওয়েব ডেস্ক ঘাটতে হয়েছে।
https://bn.wikipedia.org/wiki/চন্দ্রাবতী
milansagar.com


তাছাড়া যোগ করেছি আমার একান্ত নিজস্ব কিছু ভাবনা ও চিন্তাধারা।


অনুরোধ :
সব কিছু মিলিয়ে কবি ও কবিতার পরিভ্রমণ কেমন লাগছে জানালে আমার এই প্রচেষ্টা চালু রাখবো শুধু নয়, উৎসাহিত বোধ করবো ।