অনেক শব্দ জীবন থেকে হারিয়ে যায়, অনেক শব্দ পুরনো হয়ে যায় আবার অনেক শব্দ পচে  ফুরিয়ে যায়। আবার নতুন করে নতুন শব্দের জন্ম নেয়। শব্দের সঙ্গে জীবনের স্রোত এভাবেই চলতে থাকে। এই মুহূর্তে গত ছয় মাসে কত নতুন শব্দের সৃষ্টি হলো যে শব্দগুলো মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করে। 'করোনা', 'কোভিদ','মাস্ক', হ্যান্ড সেনিটাইজার', সোশ্যাল ডিস্টেন্স' শব্দগুলো এখন সবার মুখে মুখে। এভাবেই একদিন এসেছিলো 'জয় বাংলা' (কনজাংটিভাইটিস) শব্দটি যা আজ এই চোখের রোগটি চলে যাবার সঙ্গে শব্দটিও ফুরিয়ে গেছে। 'স্বদেশ','স্বাধীনতা','মুক্তি যোদ্ধা ' 'বিপ্লবী'  শব্দগুলো একদিন বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে শিহরণ জাগাতো। এই অত্যন্ত পবিত্র ও শুভ্র শব্দগুলোর পাশে জড়িয়ে থাকতো লজ্জা,কান্না ও  অপমান জড়ানো শৃঙ্খলিত এক কালো শব্দ 'পরাধীনতা। এই কালো শব্দটি মুছে ফেলাই ছিল আমাদের সংকল্প। আজ সাদা ও কালো শব্দগুলো মুছে গেছে কিন্তু আমরা পেলাম না সেই বহু আকাঙ্খিত 'স্বদেশ' শব্দের স্বাদ ও ঠিকানা। যে শব্দগুলো একদিন হয়ে উঠেছিল মনুষ্যত্বের রক্তাক্ত প্রতীক, সে শব্দগুলো জীবনের নাগরদোলায় হারিয়ে গেছে।  


আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা আর্য ভাষার বংশধর। তাই তাদের কিছু  শব্দ - 'ঢেঁকি' , 'দোয়েল','ঝাড়','ঝিঙ্গা' ইত্যাদি শব্দগুলো বাংলায় দৈনিক কথপোকথনে ব্যবহৃত হয়।
আবার অনেক বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের কথার মধ্যে প্রবেশ করেছে।কিছু উদাহরণ দিলে বোঝার সুবিধে হবে হয়তো।
আচার(মুখরোচক আঁচারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না) এ আচার হচ্ছে ব্যবহার।  এই আচার কথাটি এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে।'আজব' লোকতো মশাই আপনি! এই আজব কথাটি এসেছে আরবি থেকে। এভাবেই এসেছে 'আলপিন' , চাবি - পর্তুগিজ।  আন্দাজ, খারিজ,খালাসি,চাদর, এসেছে আরবি থেকে। বহুল প্রচারিত 'চিঠি' , ঝান্ডা শব্দগুলো এসেছে হিন্দি থেকে।তামাক -স্পেনীয় ,তকমা -তুর্কী ইত্যাদি।


এবারে দেখি বাংলাতে ব্যবহৃত কিছু অমার্জিত শব্দ যা সচরাচর মার্জিত লোকালয়ে ব্যবহার হয়না।যেমন খোচর(পুলিস), চোথা(টুকলি করা), পেটো (বোমা)গেজানো(গল্প করা।তবে "শালা" শব্দটি কাউকে গালি দেবার জন্যে ব্যবহার হলেও শালা ভগ্নিপতির সম্পর্কটা বড়ো মিষ্টি হয়।


কিছু আছে আবার খণ্ডিত শব্দ।  যেমন বাই-সাইকেল, টেলি-ফোন ইত্যাদি।


কিছু আছে আবার মিশ্র শব্দ। যেমন জামাই-বাবু, আরাম-কেদারা, হেড-মিস্ত্রি ইত্যাদি।


এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা ভাষায় কিছুটা বাণিজ্যিক,কিছুটা সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্যে।


ডিজিটাল যুগে আবার ঢুকে গেছে কিছু আনকোরা শব্দ।পুজোর পাঞ্জাবিকে রকের ভাষাতে এখন বলা হয় 'ঝক্কাস', গার্লফ্রেন্ড বেশি সাজগোজ করলে বলা হয় 'ঝিঙ্কু' !
এই শব্দগুলোর আসলে কি মানে এবং কোন পরিস্থিতিতে ব্যবহার হয়, কখন কিভাবে এর প্রয়োগ হয় তা নিয়ে কিন্তু বাঙালি গবেষকরা থেমে নেই জানবেন। আঁতুড়ঘরের শব্দগুলো আজ অভিধানে স্থান না পেলেও, বর্তমান প্রগতিশীল জেনারেশন এর এই শব্দগুলোর ব্যবহার নিয়ে কিন্তু কাটাছেঁড়া চলছে। 'ঝক্কাস' কথাটির অর্থ হলো আকর্ষণীয় অথবা চটকদার।এটি এসেছে একটি হিন্দি সিনেমার দৌলতে বস্তিবাসীর ব্যবহৃত শব্দ থেকে। আবার ইমেলের এটাচমেন্ট থেকে উৎপত্তি হলো এই শব্দটি যা আসলে একটু অন্যভাবে জীবনপ্রবাহের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রেমিকা যদি তার ভাইকে নিয়ে আসে সঙ্গে করে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে স্বভাবতই প্রেমিক একটু বিরক্ত হয়েই বলে 'তুমি এলে আবার সঙ্গে এটাচমেন্ট নিয়ে এলে কেন '? 'হুব্বা' মিশর রহস্য চলচিত্র থেকে এখন খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছে।  'হুব্বা' অর্থাৎ নিজেকে খুব বড় মনে করা। 'হুলিয়ে' অর্থাৎ খুব মনোযোগের সঙ্গে। ছেলেটি পরীক্ষার জন্যে হুলিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। 'পুরকি' অর্থাৎ বড়াই করা। একসময় একটি গালি দেয়া শব্দ 'চুদুরবুদুর' শব্দটি নিয়ে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশের সংসদ।ভাষাতাত্বিক রা তখন জানিয়েছিলেন চুদুরবুদুর গালাগালি নয়। শব্দটি ধন্যাত্মক অনার্য শব্দ। বাংলাদেশে শুধু নয় পশ্চিম বাংলাতেও কথাটি লঘু আড্ডাতে প্রচলিত শব্দ।এছাড়া আছে 'সেন্টু' (সেন্টিমেন্টাল)থেকে, 'ফান্ডা'(ফান্ডামেন্টাল থেকে) .


উপসংহার: ফেসবুক- হোয়াটস্যাপ প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে যেগুলো প্রতিনিয়ত বাঙালি শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়ছে  সামাজিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।আমার কাছে বাংলা ভাষার উর্বরতার জন্যে খুবই উৎসাহজনক মনে হচ্ছে।


টিকা : হাত উসখুস করছিলো বলে দীর্ঘদিন পরে আলোচনা পাতায় এলাম।
তাই আসরের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ এই ডিজিট্যাল দুনিয়ায় মাথা থেকে আমার চিন্তাগুলো অনুগ্রহ করে ডিলিট করে দেবেন না।
ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই আমার। সবাইকে তাই জানাই আমার অন্তরের প্রগাঢ় ভালোবাসা।