‘অলঙ্কার’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ সুসজ্জিতকরণ বা বিভূষিতকরণ। প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রবিদগণ বলেছেন- ‘সৌন্দর্যম্ অলংকারঃ’। অর্থাৎ সৌন্দ্যর্যই অলঙ্কার (Rhetoric)। কেউ কেউ মনে করেন, অলঙ্কারের কাজ আনন্দবর্ধন করা। অর্থাৎ ‘অলঙ্কারোহি চারুত্বহেতুঃ’। সহজ ভাষায় বলা যায়, শব্দে সাধারণ অর্থের অতিরিক্ত এক চমৎকারিত্ব সৃষ্টিই হলো অলঙ্কার। অলঙ্কারকে নারীদেহের সৌন্দর্যবর্ধনকারী উপাদানের সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু কাব্যের অলঙ্কার আর নারীদেহর অলঙ্কার এক জিনিস নয়। নারীদেহের অলঙ্কার বাহ্যিক জিনিস। কিন্তু কাব্যের অলঙ্কার অভ্যন্তরের জিনিস।


সুতরাং কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যার দ্বারা কাব্যভাষাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় তাকে অলঙ্কার বলে। এক কথায় কাব্যদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে অলঙ্কার বলে। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘যেগুণ দ্বরা ভাষার শক্তিবর্ধন ও সৌন্দর্য সম্পাদন হয়, তাকে অলঙ্কার বলে’। ড. শুদ্ধস্বত্ত্ব বসু বলেন, ‘অলঙ্কার শব্দের একটা ব্যাপক অর্থ আছে যার দ্বারা রস, রীতি, ধ্বনি, গুণ, ক্রিয়া, অনুপ্রাস, উপমা, বিরোধ, বক্রোক্তি প্রভৃতিকে বোঝায়, কারণ কাব্যসৌন্দর্য বলতে এগুলোকে অবশ্যই ধরতে হবে।’ তাই বলা যেতে পারে, কাব্য ভাষায় উপমা, অনুপ্রাস রূপক ইত্যাদি প্রয়োগে যে রসশিল্পের দ্বারা সৌন্দর্যসৃষ্টি করা হয় তাকে অলঙ্কার বলে।


অলঙ্কারের প্রকারভেদ : কাব্যের অলঙ্কার নির্ভর করে শব্দের ওপর। আর শব্দের দুটো দিক রয়েছে। শব্দের উচ্চারণ অর্থাৎ ধ্বনিগত দিক, অপরদিকে শব্দের অর্থগত দিক। যার অর্থ অভ্যন্তরীন। আর ধ্বনিগত দিক হলো বাহ্যিক। শব্দের এই বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে অলঙ্কারকে প্রধানত দুই ভাবে ভাগ করা হয়। যথা- ১. শব্দালঙ্কার ও ২. অর্থালঙ্কার। তবে ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। তাই অলঙ্কারশাস্ত্রকে নানা মাত্রিক পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।


নিম্নে এই প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।


শব্দালঙ্কার : অর্থপূর্ণ ধ্বনিসমষ্টিকে বলা হয় শব্দ। যে অলঙ্কার শব্দের ধ্বনিগত সৌন্দর্যবৃদ্ধি করে তাকে শব্দালঙ্কার বলে। এই অলঙ্কার পুরোপুরি ধ্বনিসুষমার ওপর নির্ভর করে। তাই এই ধরনের অলঙ্কারে শব্দকে বদল করা চলে না। যেমন-
১. এদেশে বিদ্যার মন্দিরে সুন্দরের প্রবেশ নিষেধ।
২. ‘বাঘের বিক্রমসম মাঘের রজনী।’


উপর্যুক্ত উদাহরণ দুটোতে শব্দের ধ্বনির পরিবর্তন করলে শব্দালঙ্কার বিনষ্ট হয়। প্রথম উদাহরণে যদি এদেশে না বলে এ প্রদেশে বা পুরো বাক্য পরিবর্তন করে বলা হয ‘এ প্রদেশে বিদ্যাশিক্ষার প্রথা অত্যন্ত নীরস’ তাহলে শ্লেষ ও অনুপ্রাস থাকে না। আবার দ্বিতীয় উদাহরণে শব্দের আদিতে ‘ব’ ধ্বনি, প্রথমটি ছাড়া অন্যান্য সব শব্দে ‘ম’ ধ্বনি এবং প্রথম পর্বের আদিতে ‘বাঘের’ সাথে মিল রেখে দ্বিতীয় পর্বের আদিতেও অনুরূপ শব্দ ব্যবহৃত হবার ফলে যে ব্যঞ্চনা সৃষ্টি হয় তাই অলঙ্কার। শব্দালঙ্কার ছয় প্রকার। যেমন- অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্লোক্তি, ধ্বনি্যুক্তি, পুনরুক্তবদাভাস। নিম্নে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলো।


অনুপ্রাস : একই রকম বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি বারবার ব্যবহৃত হয়ে যে শব্দসাম্য সৃষ্টি করে তাকে অনুপ্রাস বলে। যেমন-
১. ‘চুলতার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’
২. কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।


অনুপ্রাস নানা প্রকার। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


১. সরল অনুপ্রাস : একটি বা দুটি বর্ণ বারবার ধ্বনিত হলে তাকে বলে সরল অনুপ্রাস। মেযন-
১. ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা।
২. হাহাকার করে বেহায়া হওয়ার বেহালাখানি।
৩. কেতকী কেশরে কেশপাশ কর সুরভি।
৪. আমি চপলা মেয়ের চকিত চাহনি…।’


২. অন্ত্যানুপ্রাস : কবিতার চরণে শেষে যে মিল, তাকে অন্ত্যানউপ্রাস বলে। যেমন-
১. নাম লেখে ওষুধের
এদেশের পশুদের।
২. জিনিস যদি টাটকা না হয়
ভেঙেচুরে আটখানা হয়।
৩. আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধূলিভরা দুটি লইয়া চরণ।’


৩. গুচ্ছানুপ্রাস : একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি বারবার ধ্বনিত হলে তাকে গুচ্ছানুপ্রাস বলে। যেমন-
১. না মানে শাসন, বসন বাসন অশন আসন যত।
২. ভুলোক দ্যুলোক গোলক ছাড়িয়।
৩. নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ বিনিন্দিত অঙ্গ।
৪. কানু কহে রায়, কহিতে ডরাই, ধ্বলী চরাই বনে।


৪. ছেকানুপ্রাস : একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনিগুচ্ছ যদি দুইবার মাত্র বাক্যে ব্যবহৃত হয় তাকে ছেকানুপ্রাস বলে। যেমন-
১. এখনি অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা।
২. চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।
৩. আসার আশায় আছি।
৪. যদি না পাই কিশোরীরে আজ কি শরীরে?


৫. শ্রুত্যনুপ্রাস : কণ্ঠ, তানু, দন্ত প্রভৃতি যে কোন এক স্থান থেকে উচ্চারিত, অথচ ভিন্ন বর্ণের সাথে মধুর সাদৃশ্য ঘটলে তাকে শ্রুত্যনুপ্রাস বলে। যেমন-
১. ওই মেঘ জমছে ২. অঞ্চলের আর অঞ্চলিতে
চল ভাই সমঝে। মঞ্জরী নিস মন দলিতে।


৬. মালানুপ্রাস : অনুপ্রাসের মালা বা একাধিক অনুপ্রাস ব্যবহৃত হলে তাকে মালানুপ্রাস বলে। যেমন-
১. ইন্দীবর বর গরব গরাসিত
গঞ্জন গঞ্জন নয়না।
কোমল বিমল কমলক কৌশল
জিতষ্মিত বিকশিত বয়না।
২. শিশির কনায় মানিক ঘনায় দুর্বাদলে দীপজ্বলে।
শীতল শিথিল শিউলী বোঁটায় সুপ্ত শিমুর ঘুম টলে।
৩. কল।পনা যে অন্দ কিছু গল্প গাথা গাঁথে।


যমক : যমক শব্দের অর্থ যুগ্ম। একই শব্দ বা একই রকম শব্দ দুটি দুইবার বা ততোধিকবার উচ্চারিত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে তাকে যমক বলে। যেমন-
১. ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।
২. গুরুর কাছে লব গুরু দুখ।
৩. সুশাসনের দ্বারা হর্ষবর্ধন প্রজাদের হর্ষ বর্ধন করেছিলেন।
৪. আনাদরে আনা যায় কত আনারস।


যমক কাব্যে আদি, মধ্য ও অন্ত্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এ কারণে যমককে আদি, মধ্য ও অন্ত্য এই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।


১. আদ্যযমক :
১. উদয় উদয়পুরে প্রফুল্ল হৃদয়ে।
২. কমলা সনে কমলাসনে কমলাপতি বিহর।


২. মধ্যযমক :
১. প্রভাকর প্রভাতে প্রভাতে মনোলোভা।
২. ভাবিলে ভবের বাজি বাজি হয় ভোর।


৩. অন্ত্যযমক :
১. শয়নে-স্বপনে, ভাবিয়া তারা।
নিমিষ-নিহত নয় তারা।।
২. বাঁদরে দেখেই তাদের রাগ চড়ে।
পাজীরে করল কাহিল সাত চড়ে।।


শ্লেষ : একটি শব্দ যখন একের বেশী অর্থে একবার বাক্যে বসে তখন শ্লেষ অলঙ্কার হয়। যেমন-
১. কে বলে ঈশ্বরগুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর,
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।
২. আছিলাম একাকিনী বসিয়অ কাননে।
আনিলা তোমার স্বামী বাঁধি নিজ গুণে।।


শ্লেষ দুই প্রকার। যেমন- ১. অভঙ্গ শ্লেষ ও ২. সভঙ্গ শ্লেষ।


শব্দকে না ভেঙে যখন দুটি অর্থে তাকে প্রয়োগ করা যায় তাকে অভঙ্গ শ্লেষ বলে। আর শব্দকে ভেঙ্গে যখন দুটি অর্থ পাওয়া যায় তাকে সভঙ্গ শ্লেষ বলে। নি¤েœ উদাহরণ দেয়া হলো-
ক. অভঙ্গ শ্লেষ : অর্ধেক বয়স রাজা এক পাটরাণী।
পাঁচপুত্র স্থপতির সবে যুবজানি।।
খ. সভঙ্গ শ্লেষ : পরম কুলনি স্বামী বন্দব্যবংশ খ্যাত।


বক্রোক্তি : এক অর্থে ব্যবহার করা শব্দকে যদি প্রশ্ন বা স্বরবিকৃতির দ্বারা অন্য অর্থে সংযোজন করে ব্যাখ্যা করা যায় তাকে বক্রোক্তি অলঙ্কার। যেমন-
১. কে না জানে অলঙ্কারের অঙ্গনা বিলাসী?
২. কে হায় হৃদয় খুঁজে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।
৩. স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?


ধ্বন্যুক্তি : শব্দের উচ্চারণের দ্বারা যদি অর্থের আভাস ঘটে অর্থাৎ, বাক্যের ধ্বনিরূপ দিয়ে অর্থ প্রকাশ করা হয় এবং একটি সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়, তাকে ধ্বন্যুক্তি অলঙ্কার বলে। যেমন-
১. বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
বাজছে বাদল গামর গঞ্জর।
টাটুর টুপুর গামুর গুমুর
গামুর গুমুর টাপুর টুপুর
ঝাপুর ঝুপুর ছাপুর ছুপুর
ছাপুর ছুপুর ছাপুর ছুপুর


২. নদীর জল
চমকে চল
ছলাৎ ছল !
চলবে চল
নদীর জল
ছলাৎ ছল !


৩. লাল টুক-টুক, ঠুক-টুক, টুক-টুক হাতে নিবে ছড়ি
টিক-টিক, টিক-টিক, টিক-টিক হাতে বাজবে ঘড়ি।
গড়-গড়, গড়-গড়, গড়-গড় করে চলে যাবে গরুর গাড়ি
হ্যাট-কোট-বুক-প্যান্ট পড়ে যাবে খোকন শ ক্ষশুরবাড়ি।
সাঁই-সাঁই, সাঁই-সাঁই, সাঁই-সাঁই করে ঝড় এলো জোরে
মেঘ ডাকে গুড়-গুড়, গুড়-গুড়, গুড়-গুড় করে।
কড়-কড়, কড়-কড়, কড়-কড় করে
বিদ্যুৎ চমকায় বারে বারে।
সূত্র : আশরাফ পিন্টু, বাংলাদেশের ছড়া : পাবনা অঞ্চল।


পুনরুক্তবদাভ্যাস : অভিন্ন অর্থজ্ঞাপক বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগে যদি মনে হয় যে, পুনরুক্তি ঘটেছে এবং পরে অর্থ স্পষ্ট হলে পুনরুক্তি দোষ মনে হয় না তাকে পুনরুক্তবদাভাস অলঙ্কার বলে। যেমন-
১. তনু দেহটি সাজাবো তব আমার আভরগে।
২. ত্রিযামা যামিনী একা বসে গাহি।
কচি মুখখানি, বয়স তখন যোল,
তনু দেহ খানি ঘটিয়াছে ডুরে শাড়ি।


অর্থালঙ্কার : সংজ্ঞা, অর্থের আশ্রয়ে শব্দে যে অলঙ্কার হয় তাকে অর্থাল্কার বলে। অর্থের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যবৃদ্দি করা অর্থালঙ্কারের কাজ। অর্থালঙ্কার পাঁচ প্রকার। যেমন- ১. সাদৃশ্যমূলক, ২. বিরোধমূঠক, ৩. শৃঙ্খলামূলক, ৪. ন্যায়মূলক, ৫. গূঢ়ার্থমূলক।


নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-


সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার : দুটো ভিন্ন জাতীয় বিষয়ের মধ্যে কোনো না সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে যে অলঙ্কার নির্মিত হয়। তাকে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার বলে। সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার প্রায় চৌদ্দ প্রকার। যেমন- উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহৃতি, সন্দেহ, নিশ্চয়, প্রতিবস্তপমা, দৃষ্টান্ত, নিদর্শনা, ব্যতিরেক, ভ্রান্তিমান, সমাসক্তি ও প্রতীপ। নিম্নে এগুলো সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেওয়া হল-


১. উপমা : একই বাক্যে ভিন্নজাতের দুটো বস্তুর মধ্যে রূপগত সাদৃশ্য কল।পনা করা হলে তাকে উপমা অলঙ্কার বলে। উপমা অলকারের চারটি অঙ্গ। উপমান, উপমেয়, সাধারণ ধর্ম, সাদৃশ অথবা তুলনাবাচক শব্দ। উপমা তিনপ্রকার। পূর্নেঅপমা, স্তুপ্তোপমা ও মালোপমা।


ক. পূর্নোপমা : কোনো বাক্যে উপমার চারটি অঙ্গ অর্থাৎ উপমান, উপমেয়, সাধারণ ধর্ম ও তুলনাবাচক শব্দ প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যমান থাকলে পূর্ণোপমা হয়। যেমন-
১. রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল।
২. তোমার ছুলের মতো কালো অন্ধকার।
৩. কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ।


খ. সুপ্তোপমা : উপমার যদি দুটি বা তনিটি অনুপস্থিত থাকে সুপ্তোপমা বলে। যেমন-
১. বলেছে সে- এতদিন কোথায় ছিলেন?
পণ পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
২. লাবণ্য তোমার সখি সুধার মতন।


মালোপামা : এক উপমেয়ের যদি একাধিক উপমান হয় তাকে মালোপমা বলে। যেমন-
১. দুধের মত, মধুর মত মদের মত ফুলে
বেঁধে ছিলাম তোড়া।
২. আমি সাধারণ
তরুর মতন আমি, নদীর মতন।


রূপক : উপমেয়ের সাথে উপমানের অভেদ কল্পনা করা হলে রূপক অলঙ্কার হয়। যেমন- বালির বালিশে রোগা নদী শুয়ে আছে।


রূপক অলঙ্কার তিন প্রকার। যেমন- ১. নিরঙ্গ রূপক, ২. সাঙ্গ রূপক ও ৩. পরস্পরিত রূপক।


নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল।


নিরঙ্গরূপক : যখন একটি উপমেয়ের সাতে একাধিক উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয়, তাকে নিরঙ্গরূপক বলে। যেমন-
এমন মানব জামিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।


সাঙ্গরূপক : যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ সমেত উপমেয়ের সাথে উপমানের অভেদ কল।পনা করা হয়, তাকে সাঙ্গ রূপক বলে। যেমন-
শতাব্দী যায় গড়িয়ে
সময় সমুদ্রের সামান্য একটা ঢেউ।


পরস্পরিত রূপক : একটি রূপকের সৃষ্টি করে তাকে আরো সুন্দর ও সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রূপকের অবতারণা করা হলে, তাকে পরস্পরিত রূপক বলে। যেমন-
তুষারের মতো যায় জরে।
সব কথা আবেগের উসৃঙ্গ শিখরে।


উৎপ্রেক্ষা : উপমেয়েকে উপমান বলে সন্দেহ হলে উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কার সৃষ্টি হয়। উৎপ্রেক্ষায় কবি অজ্ঞাতসারে সংশয়ের উল্লেখ করেন। যেমন-
মনে লাগিয়েছে আঁখি
শ্রাবণ কাঁদে না আমি কাঁদি?


সন্দেহ : চমৎকারিত্বের জন্য কবি যখন উপয়েম ও উপমান দুই বস্তুতেই সন্দেহ প্রকাশ করেন, তখন তাকে সন্দেহ অলঙ্কার যমুনরা জর না সে প্রাবৃটের নব-ঘন শ্যাম?
অথবা গরল-দ্যুতি হর-কণ্ঠে নয়নাভিরাম?


অপহুতি : উপমেয়কে গোপন রেখে উপমানকে প্রকাশ করলে অপহুতি অলঙ্কার হয়। এখানে, না, নয়, চলে শব্দের প্রয়োগ থাকেএ যেমন-
বৃষ্টিচ্ছলে গগন কাঁদিলা।


নিশ্চয় : অহুতির বিপরীত অবস্থানে থাকে নিশ্চয়। উপমানকে গোপন করে উপয়েকে স্থাপন করা হলে তাকে নিশ্চয় অলঙ্কার বলে। যেমন-
কাঁপিছে এ পুরী
রক্ষোবীর পদভরে, নহে ভূ-কম্পনে।


ব্যতিরেক : উপমানের চেয়ে উপমেয়ের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বর্ণিত হলে ব্যতিরেক অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়। যেমন, বঙ্গের কোকিল কণ্ঠে আছে মধু জানি,
তা হতে অধিক মধু মঞ্জুবাক্ বঙ্কিমের বাণী।


সমাসোক্তি : বর্ণনীয় বিষয়ে অন্য বিষয়ে আরোপ ঘটলে সমাসোক্তি অলঙ্কার হয়। এক্ষেত্রে উপমেয় অচেতন ও উপমান চেতন বস্তু হয়। যেমন- ১. পর্বত চাইল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ, ২. ফিরেন নিদ্রা দুয়ারে দুয়ারে।


প্রতীপ : প্রসিদ্ধ উপমাকে উপমেয়রূপে বর্ণনা করলে প্রতীপ অলঙ্কার। যেমন- ১. মোরগ ফুলের মত লার আগুন, ২. আকাশের রঙ ঘাস ফড়িঙের দেহের মত কোমল নীল।


নির্দশনা : সাদৃশ্যের জন্য কারো ওপর কোন অসম্ভব বা অবাস্তব কল্পনা করলেই নির্দশনা অলঙ্কার হয়। যেমন-
চাঁপা কোথা হতে এনেছে হরিয়া
অনুণ কিরণ কোমল করিয়া।


প্রতিবস্তুপমা : পরস্পর সন্নিহিত দুটি বাক্যে পৃথকভাবে বিন্যস্ত এবং দুটি বিষয়ের সাদৃশ্য বর্ণনায় তাদের সাধারণ ধর্ম কল্লোল মুখরদিন ধায় রাত্রি পানে,
উজ্জল নির্ঝর চলে সিন্ধুর সন্ধানে।


বিরোধমূলক অলঙ্কার : অনেক সময় কবি তাঁর বক্তব্যকে চারুত্বমন্ডিত করতে উক্তিতে আপাতবিরোধের সৃষ্টি করেন। এই আপত বিরোধকে কেন্দ্র করে যে অর্থালঙ্কার গড়ে ওঠে তাকে বিরোধমূলক অলঙ্কার বলে। কয়েকপ্রকার বিরোধমূলক অলঙ্কার রয়েছে, যেমন, বিরোধাভাস, বিষম, বিভাবনা, বিশেষোক্তি এবং অসংগতি।


বিরোধ ও বিরোধভাস : দুটো বস্তুতে যদি আপাত বিরোধ দেখা যায় এবং সেই বিরোধে যদি চমৎকারিক্তের সৃষ্টি হয়, তাহলে বিরোধাভাস অলঙ্কার হয়। মনে রাখতে হবে, যথার্থ বিরোধ হলে বিরোধমূলক অলঙ্কার হয় না, বিরোধ শুধু উক্তিতে। অর্থ বা তাৎপর্যে নয়। যেমন- সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।


সীমা ও অসীম সত্যিকার অর্থে বিরোধী শব্দ নয়। তাই এখানে বিরোধাভাস হয়েছে।


বিষম : বিসদৃত বস্তুর বর্ণনাকে বিষম অলঙ্কার বলে, অবশ্য বর্ণনা চমৎকার হতে হয়। অন্যকথায়, কার্য ও কারণের মধ্যে যদি কোনো বৈষম্য দেখা যায়। কিংবা যেখানে কোনো আরদ্ধ বিষয়ের বিফলতা বোঝায়। তাহলেই বিষম অলঙ্কার হয়। যেমন-
যমুনার জলে যদি দেই গিয়া ঝাঁপ।
পরাণ জুড়াবে কি, অধিক উঠে তাপ।


বিভাবনা : কারণের অভাবের জন্য কার্যভাবনাকে বিভাবনা বলে। সোজা কথায়, কারণ ছাড়া কোন কাজ হলেই বিভাবনা অলঙ্কার হয়। যেমন :
এলে জীবনের বিমূঢ় অন্ধকারে
ঘরে দীপ নেই তবু আলোকোজ্জল
তোমার সৃষ্টায় দেখে নিই আপনারে।


বিশেষোক্তি : কারণ থাকা সত্ত্বেও কাজ না হলে বিশেষেক্তি অলঙ্কার হয়। কবিতার উৎকর্ষের জন্য এ রকম ভারের অবতারণা হয়। যেমন,
আছে চক্ষু, কিন্তু তার দেখা নাহি যায়।
আছে কর্ণ, কিন্তু তাহে শব্দ নাহি ধায়।


অসংগতি : কার্য ও কারণের স্থান যদি বিভিন্ন হয় অর্থাৎ এক যায়গায় কারণ ঘটে আর অন্য যায়গায় ফল দেখা যায়, তাহলে অসংগতি অলঙ্কার হয়। যেমন,
ওদের বনে ঝরে শ্রাবণ ধারা
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।


শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার : অনেক সময় বাক্য এমনভাবে সংযোজিত হয়, যাতে এক বাক্যের একটি কাজ অন্য বাক্যের কারণ হয়, সেই কারণের কাজ আবার অন্য বাক্যের কারণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার তৈরি হয়। কারণমালা, একাবলী ও সার এই তিন প্রকার শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার রয়েছে।


কারণমালা : কোনো কারণের কাজ যদি পরের বাক্যে কারণরূপে প্রতিভাত হয় এবং এ কারণের কাজ আবার তার পরের বাক্যের কারণ হয়ে ওঠে তবে কারণমালা অলঙ্কার হয়। যেমন-
থাকিলে বিজ্ঞের কাছে হয় বিদ্যালয়।
বিদ্যা থেকে হয় অর্থ, অর্থে হয় বশ
অর্থ হতে কিনা হয়? পৃথিবী ও বশ!


একাবলী : এই শৃঙ্খলাক্রমে যখন একটি বাক্যের বিশেষ্যপদ তার আগের বিশেষণ রূপে বসে, তখন একাবলী অলঙ্কার হয়। যেমন-
সুনীল আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাস, বিমল নদীর জল
গাছে গাছে ফুল, ভুলে ভুলে অলি সুন্দর ধরাতল।


সার : আগে উল্লিখিত পদার্থের চেয়ে যদি পরের বর্ণিত পদার্থের উৎকর্ষ বোঝানো হয়, তবে সার অলঙ্কার হয়। যেমন- নিজের সে বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার
সন্তান নহে গো মাতা : সম্পত্তি তোমার।


ন্যায়মূলক অলঙ্কার : বক্তব্যের মধ্যে ন্যায়বাচক থাকলে এবং উক্তির ধারা বক্তব্যকে জোরালো করলে ন্যায়মূলক অলঙ্কার হয়। অর্থ ন্যায়মূল অলঙ্কার দুই প্রকার : অর্থান্তরন্যাস ও কাব্যলিঙ্গ।


অর্থান্তরন্যাস : সামান্যের দ্বারা বিশেষ অথবা বিশেষের দ্বারা সামান্য যখন সমন্বিত হয় এবং কাজের দ্বারা কারণ অথবা কারণের দ্বারা যখন কাজ সমর্থিত হয়, তখন অর্থান্তরন্যাস অলঙ্কার হয়। যেমন-
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিয়ে সে কিছে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।


কাব্যলিঙ্গ : যখন কোন পদের অথবা বাক্যের অর্থ ব্যঞ্জনার দ্বারা বর্ণনীয় বিষয়ের কারণ বলে মনে হবে, তখন কাব্যলিঙ্গ অলঙ্কার হয়। যেমন- নির্ভর হৃদয়ে কহ, হনুমান আমি রঘুদাস, দয়াসিন্ধু রঘুকুলনিধি।