দিবস শব্দটি যত সমস্যার কারণ। না হলে বাবাতো ঠিকই ছিল। আধুনিক বিশ্বে বাবাকে সময় দেয়ার সময় যখন সন্তানের নাই, তখন একটা দিবসতো চাই। যেদিন অন্তত বাবার সাথে দেখা হবে। উপহার বিনিময় হবে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বিষয়টা বেশ চমৎকার।আবার যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পাই না বাবাকে নিয়ে কিছু লেখার, সাহস থাকার পরও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারে না- তোমাকে অনেক ভালোবাসি- তাদের জন্যও অন্তত এই দিন একটা সুযোগ আসে।বাবা দিবস এলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে, প্রকাশনায় যে পরিমাণ আয়োজন দেখা যায় তাতে আর কিছু না হোক বাবা বলে যে একজন আছে, বাবাকে নিয়ে বলার যে কিছু আছে, এটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। আজকাল ছেলে মেয়েরা এ ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে।


এই রকম এক বাবা দিবসে আমার দুই ছাত্রী বলল- তারা তাদের বাবাকে ঘৃণা করে। কারণ তিনি প্রতিরাতে ছাইপাশ গিলে আসে, আর হৈ চৈ করে সারা পাড়া মাথায় করে। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম- মন্দ হোক, ভালো হোক, তিনি তোমাদের বাবা। বাবার মতো পৃথিবীতে আর আছে কে বা? তাঁর নাকি চরিত্রে দোষ আছে। পরনারীতে আসক্তি আছে। অথচ আমার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তিনি মেয়েদের জন্য যত রকম সহযোগিতা দরকার তার সবটা করার জন্য তৈরি থাকেন। সারাদিন পরিশ্রম করে এই মেয়েদের পড়ালেখা, খাবার খরচ, থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। বিবাহযোগ্যা এই মেয়েদের কেউ তাদের বাবার বিরূদ্ধে তাদের সাথে কোন খারাপ আচরণের অভিযোগ তুলতে পারে নি। তাহলে কি দেখা গেল, ব্যক্তি হিসেবে দুশ্চরিত্র একজন মানুষ, বাবা হিসেবে যথেষ্ট আন্তরিক হতে পারে। আবার উল্টোটাও ঘটতে দেখা যায়। পত্রিকায় আসে- মেয়ের গর্ভে বাবার সন্তান, মেয়েকে বেঁধে রেখে..... ইত্যাদি।


আমরা যখন বাবা দিবসের গল্প লিখি, তখন আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি বাবাকে নিয়ে ভালো কিছু লিখব। আমার শ্রদ্ধার কথা, আমার কৃতজ্ঞতার কথা, জন্মের ঋণ শোধের কথা, আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা, আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ এসব ঠিক করাই থাকে আগে থেকেই।মুশকিল হয় তাদের বাবার সাথে যোগাযোগ হলে। দেখা যায় বাবাকে নিয়ে লেখা গল্পের সাথে বাবার কোন মিল নেই। বোঝা যায় না এটা কোন বাবা। আমার মনে হয় সবার কল্পনায় একজন "ভালো বাবা" থাকে। আমরা সবসময় সে বাবার কথাই বলি। আমাদের জন্মদাতা বাবার কথা নয়। কারণ তারা বাবাগিরি দেখাতে গিয়ে প্রায়ই ভয়ের কারণ হয়ে থাকে। শাসন করতে গিয়ে পিতার বদলে দণ্ডদাতা শাসক হয়ে যায়। চাহিদা ও যোগানের টানা পোড়নে পড়ে অযোগ্য মানুষে পরিণত হয়। সামাজিকতার দায়ে পড়ে পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করে। কিন্তু আমি একজনকে জানি যিনি পিতাকে ত্যাজ্যপিতা ঘোষণা করেছিলেন।


এক ছাত্রকে পেয়েছিলাম যে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। অভিযোগ- নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ায় তাকে ঘরে বন্দী করে রেখেছিল তার কোটিপতি বাবা। তারপর নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করালো। তার দাবী তার সুন্দর জীবনটা বাবা এলোমেলো করে দিয়েছে। এখন তার আগের বন্ধুরা নেই। একা বের হতে দেয় না। প্রাইভেটে ‘এ লেভেল’ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে...ইত্যাদি। আমার অনেক সময় লেগেছিল, বাবার প্রতি তার মনোভাব পরিবর্তন করতে।


প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন এমন এক বাবার কথা বলি। চারটে ছেলেকে মানুষ(?) করেছেন। অথচ একটা ছেলেও পাশে নেই। প্রত্যেকে নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। অসুস্থ বাবার পাশে থাকার সময় নেই কর্মব্যস্ত জীবনে। দুঃখ করে বলেন- এইজন্যই কি মানুষ ছেলে মেয়ে বড় করে। লেখাপড়া শিখায়। যদি জীবনের শেষ সময়ের ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম। সবার কথা বলছি না। কেউ কেউ সন্তান জন্ম দিয়ে, বড় করেও সার্থক পিতা হয় না।


আমি জানি তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেরা সবাই অনেক বড় করে মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠান পালন করবে। অনেক লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। মেজবান হবে বড় কোন কমিউনিটি সেন্টারে। কারণ এসব করতে হয়। লোকশিক্ষার জন্য। বিদ্যালয়ে মাতা পিতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা মুখস্থ করতে হয়। পাশ করার জন্য। বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিতে হয়। সম্মান বাড়ানোর জন্য। মাঝে মাঝে লিখতে হয়। পাঠকের জন্য। কিন্তু জীবনে এসব পালন করতে নেই। পাছে লোক জানাজানি হয়, তাই শাহজাহানের মতো একটা তাজমহল বানাতে হয় বাবার কবরের উপর। লোকে বলবে-দেখ, পিতার প্রতি পুত্রের মহব্বত। সরকারী অর্থে বানানো প্রতিষ্ঠানে বাবার নাম জুড়ে দিতে হয়। প্রয়োজনে স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতি বৃত্তিও প্রদান করতে হয়। এসবের সাক্ষী আছে। সবাই স্বীকার করবে। বিনিয়োগ লাভজনক হবে। আর গোপনে আব্বাজানের সেবা করলে তাতো কেউ জানবে না। কেউ দেখবে না। কেউ স্বীকৃতি দেবে না। তাই কাজের লোক রেখে দাও। মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাও। দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালিত হবে।


তবে কথা হচ্ছে কি, তাও হচ্ছে না। এক বয়স্ক রিক্সাচালকের সাথে কথা হলো। ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে ভালোই আছে। বড়লোকের মেয়ে। ছেলে লেখাপড়া শিখেছে। বাবাকে দেখেনা।বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। তাই বাবা এখনো রিক্সা চালায়। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। সেক্ষেত্রে অন্তত বাবা দিবস আমাদের একটা খোঁচা দেয়ার ব্যবস্থা হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা খেয়ল করিনা আমাদের বাবাদের প্রতি আমাদের আচরণ আমাদের সন্তানেরা লক্ষ্য করে। ভবিষ্যতে ওরাও আমাদের সাথে এমন আচরণ করলে আমরা ওদের দোষারোপ করবো। কিন্তু চিন্তা করবোনা এটা আমাদের কর্মফল।


আমার এক সহপাঠী বলেছিলো- শৈশবে যাদের পিতৃবিয়োগ ঘটেছে তারা সৌভাগ্যের অধিকারী। বাবার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে পার পেয়ে যাচ্ছে। বাবা জীবিত থাকলে একদম কান মলে দিতো। বলতো আদিখ্যেতা দেখানোর জায়গা পাস নি। লেখাপড়া ছেড়ে চিঠি লিখা হচ্ছে, না ? সামনে পরীক্ষা সে কথা মনে আছে? কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এতবড় বুড়ো ধারিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি গল্প কবিতা লেখার জন্য? ব্লগ, ফেইসবুক এসবই ছেলে মেয়েদের মাথা নষ্ট করছে। কোথায় রাত জেগে পড়ালেখা করবে, তা না, ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ‘গুড নাইট’। আরে বাবা কেন ভাবছো না, তখন তো তোমার আমেরিকান বন্ধুর ‘গুড মর্নিং’ হচ্ছে।


জানি, গল্পটায় কোন আবেগের কথা নেই বলে আপনার একদম ভালো লাগছে না। যদি ভোট না দিয়ে চলে যান, তাই ভয়ে ভয়ে আবার আরম্ভ করছি। জানেন! আমার বাবা এত ব্যস্ত মানুষ যিনি আমাদের একদম সময় দিতে পারতেন না। বাবা ঘরে আসার আগেই মা আমাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন। যেন আমাদের কোন আচরণে বাবা বিরক্ত না হন। আমার ধারণা বাবাকে কেউ ছেলে কত বড় হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বাবা সম্ভবত দু'হাত পাশাপাশি নিয়ে গিয়ে দেখাতো। কারণ দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেতো না তো।সকালে ঘুম থেকে উঠার আগেই বাবা চলে যেতো।মাঝে মাঝে মনে হতো বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি বাবার একঘন্টা সময়ের দাম কতো। তারপর তত টাকা জমিয়ে বাবাকে দিয়ে একঘন্টা সময় কিনে নিতাম।আমাদের শৈশব কেটেছে মায়ের তত্ত্ববধানে।


কৈশোরেও কোন কাজে বাবাকে পাশে পাইনি।সব বিষয়ে মা আলোচনা করে ঠিক করে নিতো। যখন বাবা থাকতো আমরা পড়ার টেবিলে পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকতাম।আমাদের পড়ালেখা শেষ হলো। পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এখন বাবার যথেষ্ট অবসর। কিন্তু আমাদের একদম সময় নেই।এখন বাবা ফোন করে জিজ্ঞেস করে কতক্ষণে বাসায় ফিরবো।মাকে জিজ্ঞেস করে সারাদিন ওদের এত কি কাজ। এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হয় কেন।মা বাবাকে বোঝায় ওরা বড় হয়েছে। অনেক কাজ থাকে। এসব নিয়ে অকারণ ঝামেলা করোনা। এখন সময় দেয় না। পরে বউ ক্ষেপে গেলে টাকা দেয়াও বন্ধ করে দিতে পারে। আমি ভাবি আসলেই কত ব্যস্ত আমরা। ভোর না হতে ছুটছি। মধ্যরাতে বাসায় ফিরছি। কেন এত পরিশ্রম জানি না। হয়তো আমার ছেলেও কোন এক বাবা দিবসে এসে বলবে- বাবা, এই নাও তোমার একঘন্টা সময়ের মূল্য। আমি টিফিনের পয়সা থেকে জমিয়েছি। আজকে আমাকে এক ঘন্টা সময় দাও। আমার যে খুব বাবার আদর পেতে ইচ্ছা করে।