প্রিয় মা,


এই অকর্মার ঢেঁকির ভালোবাসা নিও। গত সপ্তাহে তোমার চিঠি পেলাম; চিঠির অক্ষরগুলো বৃষ্টির ফুটো হয়ে ঝরেছিল মেসের টিনের চালে। সেদিন তুমি খুব করে জিজ্ঞেস করেছিলে, কেমন আছিস, বাবা? ছোটো বোনটা আমাকে ছাড়া এখন কি একলা ঘুমায়? বড়োদিদি কি এখন মায়ের জায়গায় সংসার দেখে? আজ সেই চিঠির উত্তর লিখতে বসেছি। বড়দিদি, মেজো বোন ঢাকায় থাকে; আমি ত্রিশালে; ছোটো বোন বাড়িতে একা মামাদের সাথে। এ সহজ বাক্য তুমি কি মেনে নিবে, মা? আমি জানি এ কথা শুনলে তুমি মৃত্যুলোক থেকে পুনরায় মর্ত্যে চলে আসতে চাইবে। সব থেকে আদরের ছোটো বোনকে গাঁয়ে একা ফেলে জীবিকার তাগিদে আমরা সবাই বেড়িয়ে পড়েছি, কী কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে!


জানো মা, ছোটো বোন এখন একলা ঘুমায়। তোমাকে সবাই যখন কফিনে শুয়ালো, ছোটোটা কী ভীষণ কান্না করেছিলো সেদিন তোমার সাথে শুবে বলে। তোমাকে বারংবার চিৎকার করে ডেকেছিলো, তোমাকে ছাড়া সে আর কারও সঙ্গে শুবে না বলে। অথচ, তুমি খুব মৌন ছিলে। আদরের মেয়েটার ছোটোখাটো আবদার যে জননী কোনোদিন ফিরায়নি,‌ সেদিন ফিরিয়ে দিলে; চিরদিনের জন্যে নিশ্চুপ রয়ে গেলে। কোনো রাত সে যে তোমাকে ছাড়া ঘুমোতো না।


মাগো, এই মর্ত্যে বাবার সাথে তোমার যে দূরত্ব ছিলো, ওখানেও কি তাই? বাবার সঙ্গে কি ওখানে তোমার কথা হয়? ইহলোকের মতো ওখানেও কি আজো অভিমান করে আছো? তুমি কি জানো তোমার চলে যাবার পরপরই ঠিক একটা বছরের মাথায় বাবাও তোমার কাছে আকস্মিকভাবে পরকালে পাড়ি জমালে?


দোহাই তোমার, নিজের জন্যে না হলেও এই ডানপিঠে ছেলেটার কথা ভেবে বাবাকে একটা বার জিজ্ঞেস করো, কেমন আছে? আমাকে আদৌ ক্ষমা করেছে কি না? জানো মা তোমাকে যতোটা ভালোবেসেছি ঠিক ততোটাই বাবাকেও ভালোবাসতাম। তুমি তো জানতে বাবা একটা উপন্যাসের নায়কের মত ছিলেন— খেয়ালী, উদাসীন, ন্যায়–অন্যায়, পাপ–পূণ্য যখন যা ইচ্ছে হতো, করতেন। জীবনকে কী ভীষণভাবে উপভোগ করতে জানতেন‌ তিনি!


বাবার সাথে আমার মান-অভিমান ছিল দীর্ঘদিন, প্রায় পাঁচ-ছয় বছর কোনো কথা হয়নি। কী ঘোর দ্বন্দ্ব ছিলো আমাদের মতাদর্শের! তুমি প্রস্থানের পর আমি প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছিলাম যে, বাবার চরণ যুগল আঁকড়ে একদিন মার্জনা যাচনা করব। সব ভুল আমি নতজানু হয়ে স্বীকার করব। তোমার চিরবিদায় আমাকে শিখিয়ে ছিলো— মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মানুষ কতোটা অসহায়। একদিন এই বিরাট বসুধার বিভু, মৃত্তিকা, তমসা, তটিনী, তরুছায়া, চারু হিয়া, শৈশবের স্মৃতি, কলহ, বিবাদ, দ্বন্দ্ব সব! সব! ছেড়ে চলে যাবো। তবে এতো মান-অভিমান, হিংসে-বিদ্বেষ জীবনে কেন? বিশ্বচরাচরে একটা ছোট্ট জীবন নির্মল ভালোবাসা দিয়ে কাটিয়ে দেবো।


ছুটির সময় বাঁশের সাঁকোর কাছে মাঝেমাঝে বাবার সাথে দেখা হতো! কথা বলতে কী ভীষণ ইচ্ছে হতো! সম্পর্কের মাঝে কী কঠিন দেয়াল জানি দাঁড়িয়েছিলো কথা বলতে চেয়েও আঁটকে যেতাম! কখনো কখনো ভোরের স্বপ্নে দেখতাম বাবা কী হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে! জেগে উঠে ফোন দিতে গিয়েও আঁটকে যেতাম; ফোনটুকু করবার সাহস সঞ্চয় হতো না। এভাবেই গড়িমসি করতে করতে হঠাৎ একদিন বাবা স্ট্রোক করে চিরতরে চলে গেলো— আমার জাগতিক দুর্বিষহ ভুলের ক্ষমা ভগবান শিকেয় তুলে রাখলো। আকাশ বিতানে লিখে জানিও মা, বাবা কি এখন তোমার পাশে? আমাকে এই ভুলের ক্ষমা কি দেবে না?


হৃদয়ের শূন্যতা ব্যতীত প্রকৃতিতে কোনোকিছুই তো ফাঁকা থাকে না। তোমার দ্বায়িত্ব, তোমার সংসার আজ বড়োদিদি দেখে, ও সামলায়। আমার থেকে মাত্র বছর তিনেকের বড়ো, অথচ দিদি তোমার মতোই আমাদের সবাইকে স্নেহ করে। বড়দিদি মানেই  মায়ের মতো আজকাল।


জানো মা বাবার উড্ডীয়মান অভিমান ভাঙাবো বলে, অনির্বচনীয় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ বাবার নিকট আত্মীয়দের থেকে একটি মেয়েকে চুপিচুপি ভালোবাসার চিঠি লিখেছিলাম বছর তিনেক আগে। তার লতানো চুলে কে জানে কী উদ্বেল মুগ্ধতা দেখেছিলাম; হরিণ চোখে কী মায়া অবলোকন করেছিলাম; তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। আজ তাকে ভালোবাসার যে কারণ ছিলো সে আর নেই— বাবা তো বিদায়ই নিলো! সেই একাদশীরও গত জুনে বিয়ে হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো মা, নন্দিনীকে শুধু বাবার অভিমান ভাঙাবো বলে ভালোবাসতাম না! আমি সত্যিই তার প্রেমে পড়েছিলাম। সে বোধ করি ভালোবাসার কারণ খোঁজে পেয়েছিল, ভালোবাসায় কি এমন স্বার্থবাদী হেতু অবস্থান করতে পারে? এও কি পাপ নয়?


সন্তান হিসেবে বাবার কাছে অযোগ্য আর ভালোবাসায় স্বার্থবাদী হওয়ায় আমার থেকে জগতের সব নৈতিকতা আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আজ আর পারছি না। তোমার আকাশ বিতানের ঠিকানায় আমার এই চিঠি যদি পৌছোয়, উত্তর দিও।


ইতি,
তোমার অভাগা ছেলে।