কষ্টে গিয়েছিলাম ভুলে প্রসব বেদনা এলে অমাবশ্যার মত শরীর
দুঃখের; কষ্ট ছিল জোনাকির মত হেসে ঝিলমিল— দুঃখ ছিল না; প্রসবের
বেদনাকে দুঃখ বলে না— কষ্ট; দুঃখ পেতে হলে যে হৃদয়ে আঘাতের
প্রয়োজন। প্রসববেদনায় কি হৃদয়ে আঘাত থাকে?  চোখের কোণ ভিঁজে গেলে পরে দেখি—
জন্মের কান্না সেরে চুপ করে আছে আমার চাঁদের হাটের তিথি।
তার আগমনে খুশির ফোয়ারা  নেমেছে, নেমেছে "চু"এর তিমির।


বিনে মালা শুধু "চু"এর বরণ ডালা দিয়ে সারা হলো; যেমনটা
হয়েছে সবার জন্মের আয়োজন। "চু"এর পরিবেশনে কত জনে অকারণ শুধু
চিৎকার করে "রেরে" ধরতে ধরতে বিবাদে-বিষাদে আনন্দ বিভার বিধু
মাটি করে দিল; মেয়ে বড়ো হলে কী হলো না হলো— তাহাদের
এই হল দ্বন্দ্বের মূল। বহুক্ষণ হুলস্থুল পরে শুরু হল মাতাল নৃত্যের—
পিতলের কলসে তবলার ঠুকঠাক, কণ্ঠে শুকনো বায়সী গান, "চু"এর
গেলাসে উত্তাল ঝুরির ঝনঝনানি; লাজুক বুড়িটা—
তখন তার অন্তঃস্থলের ভাঁড় হতে এক এক করে কৌতুকের খই ফুটাতে লাগুলো;
নৃত্যাঙ্গন সুদূরপ্রসারী অচেনা এক স্বপনচারী নিঝুম দ্বীপ হয়ে উঠল;
ঢোলের বাদক আর সেই বৈতালিক কীর্তনোৎসবের গায়ক কড়িকাঠের আগুন,
কুসুম বৃন্ত — তাহাদের চারিপাশে বৃত্তাকার মাঙ্গোলিক নাচে  সুডৌল পায়ের দুলন;
"চু"উৎসবের এই উত্তাল টলমলে নাচ-গান আমার মনেও দিয়েছিল আনন্দ বারতা।


তারপরে বহু বছরের হয়ে গেছে পার—
ফুটফুটে পরিপাটি যুবতী হয়ে উঠলো আমার মেয়ে আমারই চোখ ফাঁকি দিয়ে;
অনেকে উপঢৌকন পাঠালো বিয়ের অধীর-চঞ্চল হয়ে।
একদিন তার বিয়ে হলো; আনন্দ ধ্বনি নিয়ে ভ্রমরের মত গুঞ্জরিছে
সকলের প্রাণ; সেদিনও সেই স্থান "চু"এর তিমির রাত্রি অলঙ্কৃত করেছে।
সেই মাতাল টলমল নৃত্য, কলকল শুকনো কাঠ কণ্ঠের গীতাঞ্জলি,
চুপচাপ মনমরা শ্রেণির প্রাণিগুলোর "চু"এর নেশায় প্রলাপ প্রলয়গুলি
সেদিনও ছিল — সেদিনও ছিল আমার মনের সরোবরের মধ্যি খানে
আনন্দ সরোজিনী — "চু"এর তটিনী মাঝে জনে জনে
স্নান করেছিল আহ্লাদে সুখে নেশায় বুদ হয়ে। সেদিনও ঝগড়াঝাটির ঝড়
উঠলো:— মাতালেরা তুমুল দ্বন্দ্বে শৃঙ্খলা ছিড়লো বাসর ঘরের নিস্তব্ধতার ভিতর;
একদল তরুণেরে দিয়ে মাতালেরে স্থানচ্যুত করে দিয়ে আবার সেই
লাজুক বধূটির নেশারঘোর নাচ-গানে হাসির প্রকম্পণে ফেরা; মুখে মুখেই
কিশোরীর প্রথম দকমান্দা পরার মত স্মৃতি রোমন্থিক আনন্দের সমারোহ বইলো আবার।


তার বহুকাল পার হলে সেই দিন, যেদিনের কথা কবো বলে এত ভুমিকার
ধূসর স্বরলিপি লেখা; দকমান্দার মতো কারুকাজ সেখানে নেই; আবার
বাতায়ন'পরে দৃষ্টির ঔৎসুক্য নেই— আছে শুধু আড়ষ্টে জড়তায়
আনাড়ি রাঁধুনির শব্দের কাটাছেঁড়া রান্না:— মহাযাত্রায়
মায়ের কোল শুন্য করে গেল আমার মেয়ে; অন্তরাচলে ধ্বস, বুকের
মাঝে অশ্মাঘাত, নয়ন ধারায় উলঙ্গ লাল স্মৃতির ছায়া নেমে এলো; জীবনে সুখের
অবণী —ক্ষিতির ক্ষণ এতো ছোটো কেন হায়!
মহাকাল জীবনের সবুজ স্মৃতি—আজীবনের ভালোবাসা সবকিছু মুছে দেয়;
সবাই যার যার মত করে বিদায় নিয়ে সরে পরে ভালোবাসা ছিঁড়েছুড়ে।  প্রস্থানের কাছে
হায় ভালোবাসার কোনো দাম নেই।  অর্ঘ ধার্যের মত কোনো বস্তু নেই মৃত্যুর কাছে।
হায় মরে গেলে পৃথিবীর বুকে শুয়েও পৃথিবী বিহীন! কবরের ঠোঙায় মুড়ানো বসুন্ধরা।


সেইদিনটার মত দিন আর কারো হবে না জানি — কবরে মাটি দিয়ে বুকে কঙ্কর
বেঁধে উঠোনে পৌছুতে না পৌছুতেই দেখি গারোদের প্রথাগত "চু"এর আসর
শুরু:— ধীরে ধীরে নেশায় মেতে উঠে সেই স্থান, সেই "চু"এর তিমির, মাতালের অস্থিরতা
ভরে শুকনো গান, টলমলে নাচ, মাতালের সেই অকারণ ঝগড়ার ক্ষিপ্রতা।
প্রতিটি "চু"এর তিমিরের মত আবার জমে জমে উঠলো সবাই মাতালে–নেশায় বিভোর
হয়ে; সেদিনও মাতালেরা উঠোন ভরে হাসি আনন্দে গোগ্রাসে গিলেছে। ধরণীর
বুকে মেয়েকে হারানো মত যতখানি যন্ত্রণা, তারও চেয়ে গভীরে দুঃখের শৈল —
মৃত্যুর স্তব্ধতা চিরে মাতালের বিটঘুটে চিৎকার, দ্বন্দ্ব-বিবাদ, টলমলে নাচ-গান;
এই নেশাতুর বিষ মাতালের নয় — "চু"এর। নেশায় কার আর ঠিক থাকে প্রাণ?
আমি গারো হয়ে মরতে চাই না তাই;
মাতালেরা আমার মৃত্যুতেও দারু পান করবে যেটা আদিকাল হতে করে
গোত্রের পরম্পরা নিয়ম–প্রথা দেখিয়ে। মৃত্যুর সময় মদ পান — এ-কি কোনো জাতির প্রথা হতে পারে ?


১০/০২/২১
ঘোষবেড়, হালুয়াঘাট