(মোট তিনটি পর্বে শেষ হবে।) প্রতিটি পর্বই পড়ার আমন্ত্রল রইল।
আজ এর ১ম পর্ব:


আসমানী নাম শুনলেই মনে পরে যায়, বিখ্যাত বাঙালী (পল্লী কবি)জসীম উদ্দীনের সেই হৃদয় বিদারক –“আসমানী” কবিতার কথা। নামে যেমন মিল আছে, তেমনি জীবন যাত্রায়ও হুবহু মিল আছে। শুধু মাত্র সময়ের ব্যবধান মাত্র। মা বাবার একটি মাত্র সন্তান, অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাবা রহমত আলী ও মা চামেলী বেগম। জন্মের পর থেকে-৬ বছর পর্যন্ত আসমানী আসমানের নিচেই বড় হয়েছে বলে বাবা মা তাকে, আসমানী বলে ডাকে। আসমানীর মা পাশের বাড়িতে (চেয়ারম্যান বাড়ি)ধোয়া মোছার কাজ করে, আর বাবা একই বাড়ির ক্ষেত খামার দেখা শোনা করে। আমরা আসমানীর জীবন সম্পর্কে অবশ্যই জানবো, তার আগে জেনে নিব কয়েক বছর আগের কিছু কথা। অর্থাৎ বর্তমান যিনি চেয়ারম্যান, তার বাবার জীবনের কিছু কথা। যার সাথে জড়িত রয়েছে আসমানীর পরিবারের বর্তমান অবস্থা।
শুনেছি, রহমত আলীর বাবা সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন সমাজ সেবক ছিলেন। আর চেয়ারম্যানের বাবা ছিলেন তার চিরপ্রতিদ্বন্দি। সমাজের একমাত্র অবিভাব হওয়ায় চেয়ারম্যানের বাবা শত্রুতাবসত রহমত আলীর বাবার সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। খুবই সাদাসিদে মনের মানুষ হওয়ায় রহমতের বাবা তার সাথে প্রায়সই পেরে উছতেন না। তাই রহমতের বয়স যখন ছয় বা সাত এমন সময়, চয়ারম্যানের বাবার আইনি মার প্যাঁচে সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যায়, আর সেই শোকে রহমতের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। আর এই সুযোগে চেয়ারম্যানের বাবা, রহমতের মাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। এ অপমান সহ্য করতে না পেরে তার মা আত্মহত্যা করে। অবিভাবকহীন রহমত আলী তার এক বোনকে নিয়ে ঠাই নেয় খোলা আকাশের নিচে। কোথাও কোন ঠাই মিললনা তাদের। ফিরে আসতে নিজ বাবার ঘাতেকরই কাছে। ঘাতক সুযোগ বুঝে তাদেরকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য দানের সুযোগ দেয়। তবে তারা জাতে ব্রাহ্মন হওয়ায় বাড়িতে থাকার ব্যবস্তা করলনা। গোয়াল ঘরে থাকতে হবে। তবুও রাজি হলো রহমত। ভাই বোন মিলে সারাদিন কাজ করে পেত এক বেলা খাবার, যা দিয়ে তাদের অর্ধ্যেক ক্ষুধাও নিবারন হতোনা। এভাবেই চলল প্রায় পাঁচ বছর। অর্থাৎ আস্তে আস্তে দুজনই বড় হতে লাগলো, পাশা পাশি চেয়াম্যানও (দেনেশ চন্দ্র সাহা) সমবয়সী। তাই ওরা পরস্পর পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে। এটা একদিন চেয়ারম্যানের বাবা লক্ষ করে, এবং প্রচন্ড রকমে রেগে যান, সেই সাথে মালিকের ছেলের নাম ধরে ডাকার অপরাধে বাড়ি থেকে বের করে হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে রহমতের বোনের প্রতি নজর পরে মালিকের ছেলে দেনেশ চন্দ্র সাহার(চেয়ারম্যানের)। তাই সে নিজেও বের না করার জন্য বাবাকে অনুরোধ করলো। দেনেশের বাবা কিছুই শুনলোনা। বাড়ি থেকে বের করে দিল। আরেক যন্ত্রণায় পা রাখলো রহমত ও তার বোন। বয়স তখন ১৫-১৬।দারিদ্র ও সামাজিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওযার প্রত্যয় নিয়ে নতুন ভাবে যাত্রা শুরু করল ওরা। অনেক কষ্ট করে বোনকে স্কুলে ভর্তি করে পড়াশোনার করার জন্য। কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় সবাই কেমন যেন হাসাহাসি করে। গায়ে খেটে বোনকে খাওয়ায় এবং নিজে খায়। থাকে মন্ডল বাড়ির পিরিত্যাক্ত ঘরে।এভাবেই চলে বোনের পড়ালেখা ও নিজের স্বাবলম্বি হওয়ার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে সমাজের চরম অসহযোগীতার মধ্যেও রহমত কি পারবে জয়ী হতে? পাঠক বন্ধুরা আমরা রহমতের সংগ্রামে পাশে থেকে দেখতে চাই রহমত জয়ী হয়, না কি পরাজয়ের কাছে হার মানে।
সংগ্রামের ১০ বছর:
রহমত ১০ বছর নিজের সাথে সংগ্রাম করে যেন হাপিয়ে উঠেছে। কিছুতেই আর এ সংগ্রাম চালানো সম্ভব হচ্ছেনা তার। তবে সে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। বোনটা এসএসসিতে সবচেয়ে ভাল ফল করেছে। কিন্তু সামনে আর এগোনোর কোন উপায় নেই তার। তাই বোনটার বিয়ে দিয়ে একা হতে চাইছে রহমত। ওদিকে দেনেশ রহমতের বোনের প্রতি এখনো দৃষ্টি দিয়ে আছে। বার বার রহমতকেও সরসরি জানিয়েছে দেনেশ। কিন্তু দু’ধর্মের এমন সম্পর্ক হয়না। আর তাছাড়া রহমত দেনেশেদর সাথে এমন যোগাযোগ রাখতে চায়না। কিন্তু ভাগ্যের লিখন যায়না খন্ডন। তাই হয়ত আবারও দেনেশদের স্মরনাপন্ন হওয়ার আসঙ্কা করছে রহমত। কারণ গ্রামের মধ্যে সাহায্য করার মত কোন সচ্ছল ব্যক্তি নাই। রহমতের বোনের বিয়ের জন্য বেশ ক’জন প্রস্তাবও করেছে কিন্তু টাকার চাহিদা অনেক বেশি। সবাই মেয়ের সাথে সাথে মোটা অংকের টাকাও দাবি করে। দিন আনে দিন খায় রহমত, এত টাকা সে কিভাবে দেবে! রহমত উপায় খঁজতে ছুটে বেড়ায়। কোন উপায় নেই, এর মধ্যে দেনেশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায়  নতুন কৌশল অবলম্বন করে দেনেশ (চেয়ারম্যান)। দেনেশ রহমতের কাছে লোক মারফত ডেকে পাঠায়। রহমত যেতে রাজি না হওয়ায় তারা জানিয়ে দেয় যে, দেনেশের বাবার কাছ থেকে যে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছিলে সেটা ফেরত দিতে বলেছে। জীবন সংগ্রামে কিছুটা জয়ের মুখ দেখার আগেই নতুন পরীক্ষায় রহমত। রহমত তাদের উপর রেগে উঠতেই চেয়ারমেনের লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে গেল চেয়ারম্যানের কাছে। রহমত চিৎকার করে বলতে লাগল তোদের কাছ থেকে কিসের টাকা নিয়েছিলাম? কোনদিন এক গ্লাস দুধ পর্যন্ত দিসনি আর ত্রিশ হাজার টাকা! চেয়াম্যান বলল তুই তোর বোনকে পড়াবি বলে বাবার কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছিলি তার প্রমান আমার কাছে এখনো রয়েছে। বাবা বলেছিল এত টাকা শোধ দিবি কি ভাবে? তুই তো বলেছিলি আপনার বাসায় কাজ করেই শোধ দিব, কয়েক বছেরেই তা ভুলে গেলি? এত বড় সত্যিটাই যখন ভুলে যাচ্ছি তখন তোকে আর বেশি সময় দেওয়াটা বোকামো হবে। তাই আগামী মাসের পয়লা তারিখে আমার টাকা বুঝিয়া দিবি। এখন যা। রহমতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একদিকে বোনের বিয়ের টাকা অন্য দিকে চেয়ারম্যানের চক্রান্তের দেনা। কিন্তু সবার সামনে চেয়ারম্যান যেভাবে সাক্ষী প্রমাণ দেবার কথা বলল, মনে হয়না সে সহজে ছাড়বে। এত বড় একটা মিথ্যা দেনার চাপে কেন ফেলল তাকে, ভেবে কূল কিনারা করতে পারছে না রহমত। মনে মনে দুটো গালিও দিল সে, বলল ঐ মালায়নের বাচ্চার প্রস্তাবে রাজি না হওয়াতেই হয়ত এই চাপ। আমিও সহজে ছাড়ছিনা। মনে মনে ভাবে রহমত। কিন্তু মনবল যতই থাকুক অর্থ যেখানে নাই, মনবল সেখানে স্থবির। এভা্বেই পার হল একটি মাস। কিন্তু রহমত কোন ব্যবস্থাই করতে পারেনি। ওদিকে দেনার টাকা পরিশোধের জন্য চেয়ারম্যান সালিশ ডেকেছে। কাল সালিশ। সালিশে যারা রায় দেবেন তারা তো সবাই চেয়ারম্যানের লোক। তাহলে রায় তো তার পক্ষেই হবে। বিষয়টি যতই মিথ্যে হোক, তারা যেভাবে উঠে পরে লেগেছে তাতে রহমতের কাছ থেকে পাওনা আদায় করেই ছাড়বে। রহমত চিন্তায় মনবল একপ্রকারে হারিয়েই ফেলেছে। তবু নিজেকে শক্ত করে রাখার চেষ্টা করে ছলেছে। এভাবেই রাত কাটিয়ে দিল রহমত। সালিশের মাত্র ত ঘন্টা বাঁকি। সালিশের সব প্রস্তুতি শেষ, রায়ও তৈরি হয়ে আছে সবাই এলে রহমতকে জানানো হবে। সকাল ৯.০০ টা, পারার সবাই এলো কিন্তু রহমত এখনো এলো না। দেড়ি দেখে সবাই বলতে লাগল টাকা দেওয়ার ভয়ে সে কোথাও ভাগছে দেখ। সে আর আসবেনা চল সবাই, আর কতক্ষণ বসে থাকবো? চল দেখি ও কোথায় আছে বাইন্ধা নিয়া আসি। এমন কথা বলাবলি করছিল সবাই ঠিক সেই মহুর্তে রহমত এসে উপস্থিত। এবং রাগান্বিত কন্ঠে বলল কি হয়েছে বলুন। সবাই বলল দেখ রহমত রাগের কথা না, টাকাটা নিছো অনেক দিন হইল এবার যেহেতু চেয়ারম্যান চাইছে দিয়ে দাও না। কেউ বলে আরে রহমত হয়ত টাকা নিয়েই এসেছে, নইলে কি আর এত গরম কথা বলে? আরো কতই না কথা বলতে শুরু করল। রহমত বলল যে, কোনদিনই তাদের কাছ থেকে পাই পয়সাও নেইনি আর ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। একথা শোনার সাথে সাথে সবাই ক্ষেপে উঠলো রহমতের উপর। আরো অনেক কথা, সেসব আমরা সময় এবং সুযোগ পেলে পরে জানবো। এখন আমরা শুধু জানবো যে, রহমতকে শেষ মেষ কি করতে হবে। সেটা হলো, গ্রামে থাকতে হলে হয় টাকা ফেরত দিতে হবে, না হয় চেয়ারম্যানের কথামত চলতে হবে। আর সেই থেকেই রহমত চেয়ারম্যানের বাড়ির স্থায়ী কর্মচারী। দেনাও শোধ হবেনা কাজও শেষ হবে না। অনেক প্রতিবাদের পরও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু চেয়ারম্যান যে আশায় এত নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিল, সেই আশারই যেন মৃত্যু হল। অর্থাৎ রহমতের বোন তার পছন্দের ছেলের হাত ধরে বিয়ে করে ফেলল। এতে রহমতের চিন্তার যেমন অবসান ঘটল, তেমনি চেয়াম্যানের চক্রান্তের চরম পরাজয় হল। রহমত ধৈর্য্যের শেষ পরীক্ষা দিতেই সব কিছু আস্তে আস্তে মানিয়েও নিল।
এরই কয়েক মাস পর: রহমতের বিয়ে ও আসমানীর জন্ম এর পরের পর্বে।