কবীর হুমায়ূনের ‘জীবন কথা’ জীবনেরই কথাচিত্র
রহমান মুজিব


জীবন রহস্যময় । ব্যাক্তি জীবন , সমাজ জীবন, মহাজীবন । জীবন বিচিত্র । জীবনের গল্পে বৈচিত্র্য। এ গল্প কজন পড়তে পারে! জীবনের বহুপথ পেরিয়ে এসেও তার অন্তরাত্মায় কতটা পৌছা যায়? তাই নানানজন নানা ভাবে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনরে চিত্র আঁকে। দেখে। অন্যকে দেখায়। তবুও কি দেখার শেষ হয়? ‘এ দেখার নেই কনো সীমানা !’ শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-ধর্ম,বিজ্ঞান সবইতো জীবনের জন্য, জীবনরেই কথা বলে,বলছে, বলবে।কবি কবীর হুমায়ূনও জীবনকে দেখে তাঁর কবিতায় কিছু ছবি এঁকে আমাদের দেখাতে চেয়েছেন।অতঃপর অমোঘ সত্যের কথা স্মরণ করিয়ে  উজ্জীবনের ডাক দিয়েছেন । কবির কথায়,


“বেলা শেষের স্রোতে যখন উজান পানির তোড়,
আরেকটিবার লম্ফ দিয়ে আন রে মনের জোর
পথে পথে দে বিলিয়ে এই জীবনের ঋণ
একদিন তুই হয়ে যাবি অস্তপারে লীন…”।


তারপর  তিনি  তাঁর দেখা কিছু  দৃশ্যরে অবতাড়না করেছেন। কবি দেখেছেন জীবন অনন্ত সম্ভাবনাময়।  কিন্তু এ অমীয় সম্ভাবনা নীল বিষাদের অবহেলায় ভেসে যাচ্ছে । জীবনের মূল্যবোধগুলো ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে ফলে স্বপ্ন হারিয়ে জীবন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং বিবর্ণ হয় যাচ্ছে । কবির কথায়,


“ এ জীবনের সম্ভাবনা নিরন্তর খেলে
নীল বিষাদের নোনাজলে ভাসে অবহেলে।
আদ্যিকালের সূর্যগুলো পুড়ে পুড়ে ছাই,
জ্যোৎস্না ঝরা স্বপ্নগুলো শুধু খুঁজে বেড়াই;
ধোঁয়াশাতে জীবন চলে চপল চরণ ফেলে”।


তিনি সমাজ ও রাজনীতি পরিলক্ষ করে আরো দেখতে পান ওখানে আদর্শ আজ ছেঁদো কথায় পরিণত । আত্মস্বার্থে পরস্পর বিরোধী মতবাদ এক হয়ে রাজ করে বেড়াচ্ছে। সাপে ব্যাঙের গাল চাটছে। সাদা আর কালোর ফারাক নাই। সব যেন অন্তঃসার শূন্য। তিনি আয়ূধ নিয়েছেন আমাদের সমাজ ও স্বর্ণালি মুক্তিযুদ্ধ থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। আর খান সেনাদের দোসর হয়ে ঘৃণ্য রাজাকার দেশ মাতার সাথে চরম গাদ্দারি করে গেছে।জোটের নামে আজ উভয়ে একছাতার নিচে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের।যারা চরম স্বৈরাচার তারা আজ গণতন্ত্ররের গল্প শুনায়। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! যারা অন্যের অধিকার হরণ করে তারাই আজ নীতিবাক্য কপচান! ‘চোরের মায়ের বড়ো গলা’ প্রবাদরে কথা বিফলে যায় কি করে? নীতিহীনতাই আজ নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।কবি তাই চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেন,


“আদর্শ আজ ছেঁদো কথা রাজনীতির এ মাঠে
মুক্তিযোদ্ধা ভাত খেয়ে যায় রাজাকারের বাটে।
গণতন্ত্ররের গল্প শুনায় চরম , স্বৈরাচার….”


সাদামাটা কথায় এভাবেই কবিতাটি বুঝে নিতে পারি। ম্যাগনিফায়িং গ্লাসে ‘রূপক এবং প্রতিক’ হিসেবে “বেলা শেষের স্রোতে/ উজান পানির তোড়/ আদ্যিকালের সূর্যগুলো/ জ্যোৎস্না ঝরা স্বপ্ন/মুক্তিযোদ্ধা,রাজাকার/গণতন্ত্র, স্বৈরাচার /অস্তপারে লীন” এ শব্দবন্ধগুলোর শব্দাতীত বোধ, জীবনের বৃহৎক্ষেত্রে বিবর্ধক রেখায় যদি চিন্তা করা যায় তাহলে ব্যাক্তি জীবন-সমাজ জীবন-মহাজীবনের কিছু ঝলমলে ছবি দৃশ্যমান হয়ে সামনে আসে। যার সারকথা - বাধক্য কিংবা জীবনের চরম দুরাবস্তায়ও মানুষকে উজ্জীবিত থেকে জীবনের ঋণ সোধতে হবে। কারণ তাকে জায়গা ছেড়ে যেতে হবে। সত্য-ন্যায় ইত্যাকার প্রতীতিগুলো পুরান ভেবে সাম্য- শান্তি ও মানব প্রেমেপূর্ণ জীবনকে ধোঁয়াশাতে ফেলা যাবে না। সূরশক্তি আর অসূরশক্তির একাকার রোধ করতে হবে। আজকাল ভূতের মুখে যেভাবে রাম নাম শুনা যাচ্ছে তা দেখে ভীতু হলে চলবে না। প্রবল মনের জোরে সকল বাধা ছিন্ন করে জীবনের দায় মিটাতে হবে।


এমন সুন্দর আহবান একটা কবিতায় পেলে কেন মুগ্ধ হবেন না? স্বরবৃত্ত ছন্দে ‘ককখখক’ পাঁচ চরণের লিমেরিকীয় মিল বিন্যাসে তিন স্তবকে রচিত কবিতাটির শব্দচয়ন  আকর্ষণিয়। নামকরণ যতার্থ। ছন্দ প্রায় নিখুঁত।৪/৪/৪/১বা ২ মাত্রা বিন্যাস।আমি বিমুগ্ধ। কবিকে অভিনন্দন।


কবির প্রতি:- একদিন তুই /হয়ে যাবি /অস্তপারে /লীন। এখানে যথা নিয়মেই ‘এক,দিন, তুই’ তিন রুদ্ধ সিলেবলের শব্দকে ৪ মাত্রা ধরেছেন। কিন্তু “এ জীবনের /সম্ভাবনা/ নিরন্তর/ খেলে।” এখানে ‘ নি,রন, তর’ দুই রুদ্ধ এক মুক্ত সিলেবলে ৪ মাত্রাতো হয় না। এখানে ‘ যায় অবিরাম’ করলে কেমন হয়?