“হঠাৎ খবর পাই মনে
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই”। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


কত শখ করে, মেধা- মনন ব্যবহারের মাধ্যমে নানা উপকরণে মানুষ গৃহকে সাজায়। জানলার পর্দা থেকে ওভেন, ফ্রিজ, গাড়ি কত কিছু! উচ্চবিত্তের লোকেরা যেমন করে, আজকাল অল্প আয়ের, অল্প যোগ্যতার লোকেরাও করে। সাজসজ্জা করার বেলায় সবাই এক রকম। কবির কথায়,


“অনেক শখ করে
শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে…
একটা ঘর সাজাই
জানলা দরজায়
রং মিলিয়ে পর্দা
ওভেন, ফ্রিজ….
…………
এমনকি করে আজকাল
অল্প আয়ের লোকেরাও
অল্প যোগ্যতার মানুষগুলো
কিভাবে করে? কি করে?”  


বর্ণিত সবকিছু কবির চোখের সম্মুখেই ঘটে। তাই তিনি জোনেন। কিন্তু অল্প আয়ের, অল্প যোগ্যতার লোকেরা এগুলো কিভাবে করে? কি করে? একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে চলা কবি আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর জানেন না। কবির ভাষায়,


“একটা ঝড় আসে অনির্দিষ্ট
ছড়িয়ে পড়ি দিকহীন
স্বপ্ন- ঘর মুখ থুবড়ে পড়ে–


নতুন মানুষেরা আসে
তারাও আমার মতো
স্বপ্নিল হয়ে উঠে–”


এভাবে কবি জানেন, মরণ ঝড়ের কবলে পড়ে অর্জিত পার্থিব সম্পদ ফেলে চলে যেতে হয়। নতুনেরা আসে। তারাও আবার স্বপ্ন বিভোর হয়। চলছে খেলা চক্রাকারে। উত্তম পুরুষের সারলিক কাব্য বয়ানে এটুকু উচ্চারিত। এবার চলুন কাবতাটির আরও কিছু দিক, বক্তব্যের প্রসারণ, কোনো কথা না বলেই অনেক কথা বলেছেন কিনা, এসব বিষয়ে খানিকটা ভেবে দেখি।


মানবশিশু পৃথিবীতে এসে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে, বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ভোগ-বিলাসী জীবন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। এই আরাম আয়েশ  হাসিল করার ক্ষেত্রে যাদের আছে তাঁরা এবং যাদের নাই তাঁরাও সমভাবে ঈপ্সিত- লিপ্সিত হয়ে পড়ে।রবীন্দ্রনাথ তাঁর “বাঁশি” কাবতায় দেখিয়েছেন সংগীতের সুর আমির- ফকিরের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়। আর এখানে পরোক্ষে পাই, পৃথিবীতে ধনি-নির্ধনের এত ব্যবধান তথাপি ভোগ্যবস্তু আহরণে সবাই ব্যস্ত। কবি এখানে আরেকটা বিষয় ইংগিত করেছেন, অল্প আয়ের, অল্প যোগ্যতার লোকেরা যে ভোগ-বিলাসী দ্রব্যসম্ভারে ফুলেফেঁপে উঠে তা কিভাবে করে? তারা কি করে? তাদের আয়ের উৎস কি? তিনি জাহাজের খবর ঠিকই জানেন। কবি সুকুমার রায়ের “পাত্র সমাচার” ছড়ায় পাত্রের গুণ বর্ণনার মতো তিনিও প্রশ্নটুকু ঠিকই উথ্থাপন করে গেছেন। এখানে কবির কাছে সম্পুরক প্রশ্ন, কেবল অল্প আয়ের, অল্প যোগ্যতার লোকেরাই কি ডানহাত বামহাত সমান ভাবে চালায়? বেশি যোগ্যতার লোকেরা কি করে না? বাস্তবতা কি বলে? একপেশে হয়ে গেল না?


এ কবিতার অসুচ্চারিত যে জিনিসটা বেশ টানে তা হচ্ছে, এই যে আমারা অরাম আয়েশের অদম্য বাসনায় ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করেই নানাকিছু করে বসি, বাড়ি করি, গাড়ি করি, ঘর সাজাই– আমার আসল ঘরের খবর কি? ঝড় এসে যখন পরান পাখিটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তখন এগুলো কোথায় থাকবে? লালন যেমন বলেন, “একটা বদ হাওয়া লেগে পাখি কখন যেন উড়ে যায়!” প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি বাড়ি গাড়ি করা যাবে না? কবি কিন্তু নিষেধ করেননি।কেবল বিবেককে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। কি করছি? কেন করছি? কিভাবে করছি? এ কবিতার  ভাব রাজনৈতিক ভাবেও বিবেচনা করা যায়। গদি পেলাম, চেলাসহ খেলাম। ঝড়ে গদি নাই। কিছু নাই। অন্য দল আসে আবার যেই সেই।


২৪ লাইনের কবিতাটির প্রথম আঠারো লাইনে কবিতা খুঁজেছি? কিন্তু পরবর্তী ৬ লাইনে শিরদাঁড়া খাড়া করতে হয়। এখানে এসে কবিতাটি অসাধারণ বক্তব্যে অনন্য হয়ে ওঠে। এটি কবির কৌশল। সাদামাটা ভূমিকা ও বিস্তারের পর, একেবারে শেষদিকে মূল কথা বলে দেয়া। মূল কথাটা হচ্ছে, মানুষের ভারসাম্য হীন আচরণের কালোমেঘে যখন আকাশ ছেয়ে যায় তখন ঝড় ওঠে। সভ্যতা বিনষ্টকারী ঝড়। ইতিহাসে এমন নজির বিদ্যমান। অন্যদিকে অমোঘ নিয়মে তেল ফুরালে বাতি নিভবেই। এটিও এক ঝড়।ফলে এত সাজসজ্জা করেও থাকা যায় না । সব ফেলে “সুন্দর এ প্রথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে”। আবার নতুনেরা আসে। তারাও আবার স্বপ্নলি হয়ে ওঠে। তাই কাবতাটির নামকরণ স্বার্থক। কবিতার শব্দচয়ন সরল হলেও তরল নয়।


সুতরাং মেধাবী কবি সুমন এর ‘স্বপ্নলি হয়ে উঠে” কাবতাটি জগত সংসারের এক সিম্ফনি । যেন একটা চরকি। এ চরকি চলে চক্রাকারে, একদিন এ চরকি থেমে যাবে….।


এমন সুন্দর বোধের কবিতার জন্য  কবিকে অভিনন্দন।


কবির প্রতি: মানুষ শব্দটি (জাতিবাচক) বহুবচন । ‘মানুষেরা’ শব্দটি প্রচলিত হলেও কতটা সঠিক? কবিতায় কমা, প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করা হলেও দাড়ি ব্যবহার করা হয়নি। যতি চিহ্ন ব্যবহারে একটু যত্নের দাবি রাখে।কাবতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাজালে আরো ভাল লাগতো মনে হয়।