লোক সাহিত্য একটা দেশের মাটি ও মানুষকে এক সূতায় গেঁথে দেয়। লোক সাহিত্যে মাটিলগ্ন মানুষের দুঃখ-বেদনা, হর্ষ-আনন্দ, ভালোবাসা-প্রণয়, পরিণয়-বিচ্ছেদ, দেশপ্রেম-জাতি বোধ- বিশ্ববীক্ষা, যুদ্ধ, বাদ- প্রতিবাদ ইত্যাকার বিষয়াবলি অকৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ধরা দেয়। আর তা যদি হয় কাব্য বা গীতি তাহলে তো কথাই নেই– পাওয়া যায় মাটিগন্ধি ব্যাঞ্জনার এক নিরেট রসধারা।


দুদিন থেকে আফগান ‘লান্দে’ পড়ছি। এর রস কিছুটা অনুধাবন প্রয়াসে কথাগুলো মনে দোলা দিচ্ছিল। বলা বাহুল্য, অনুবাদ পাঠ থেকেই লান্দে সম্পর্কে কিঞ্চিত জানা। অনুবাদে মূলের স্বাদ পাওয়া দূরহ। তথাপি এটি মনকে এতটা অন্দোলিত করল, দুছত্র লিখতে বসে গেলাম।


‘লান্দে’(Landay ) কি?


আফগান ‘লান্দে’ কবিতা হচ্ছে পশতু ভাষায় রচিত দুই লাইনের ২২ মাত্রার  লোকজ ধারার ছোট কবিতা। প্রথম লাইনে ৯ মাত্রা, দ্বিতীয় লাইনে ১৩ মাত্রা। এতে অন্ত্যমিল ঐচ্ছিক। শত শত বছর থেকে আফগান নারীরা মুখে মুখে লান্দে চর্চা করে আসছে। প্রতিদিনকার জীবনচিত্র, নারী ও পুরুষের শাশ্বত প্রেম-প্রণয়, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অন্তরস্থ বিষণ্ণতা, হতাশাবোধ এসবই লান্দ কবিতার বিষয়বস্তু। বর্তমান আফগান সমাজ কট্টর । এখানে বিবাহপূর্ব প্রেম মানেই মৃত্যুর নাম। বিয়ের নামে এখানে নারী কেনাবেচা হয় বলে জানা যায়। অধিকাংশ ক্ষত্রে তাদের বর হয় শিশু  কিংবা বৃদ্ধ- এই হল সাধারণ প্রথা। এই শিশু বা বৃদ্ধ স্বামীকেই তারা বলে ছোট বিভীষিকা। লান্দেতে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদটাও থাকে। লান্দে কবিকে যৌনতার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়। মৌখিক ধারায় রচিত বিধায় লান্দের রচয়িতা সুনির্দিষ্ট থাকে না।  আসর বসিয়ে আড়ম্বরে লান্দে গীত হয়। এটি খুবই জনপ্রয়ি।


“লান্দে  Landay (LAND-ee)” পশতু ভাষার শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘ ক্ষুদ্র বিষধর সাপ’। এ শব্দটি থেকেই লান্দে  কবিতার  নামকরণ । লান্দের চরিত্রের সাথে এ নামকরণ যতার্থ । পশতু আফগানিস্তানের দুটি রাস্ট্রভাষার একটি। এ ভাষায়  প্রায় দশ লাখ আফগান কথা বলে।


“লান্দের  (Landay )” সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে,
“The landay is a traditional Afghan poetic form consisting of a single couplet. There are nine syllables in the first line, and thirteen syllables in the second. These short poems typically address themes of love, grief, homeland, war, and separation.The poetic form, traditionally sung aloud, was likely brought into Afghanistan by Aryan nomads thousands of years ago. "Landay," in Pashto, means "short, poisonous snake", likely an allusion to its minimal length and use of sarcasm.”


আমার করা কয়েকটি অনুবাদ দৃষ্টান্তরূপে উপস্হাপন করা হলো। এতে ছন্দ মানার প্রয়াস আছে।


*
কোনটা নেব, বলবে বন্ধুরা?
বিলাপ আর নির্বাসন দুটোই দুয়ারে খাড়া। (নির্বাসন)
*
এই মাঝরাতে এলে না তুমি
কম্বল, দেহ দুটোই জ্বলছে তুমুল অনলে! (প্রেম)
*
মাঝবুকে তোর না পাই যদি ঘা
কিছুই আমার যায় আসে না পিঠ হলে ঝাঝরা । (যুদ্ধ)
*
না প্রেম, না যুদ্ধ জানে মিনসে  
পেট ভরে গেলে ফিরে নাক ঢাকায় রাতে! (মনস্তাপ/ছোট বিভীষিকা)
*
আমায় তুমি বেচে দিলে বাপ
আল্লাহ্‌ নাশুক বাড়ি তোমার কন্যা ছিলাম, ছিঃ । (মনস্তাপ)
*
হোয়াইট হাউজ দাও হে ধ্বংসে
দেখাও ওদের শেষটা, যারা বোমায় পুড়ায় দেশ।(দেশপ্রেম)
.
লান্দের বৈশিষ্টগুলো যে ভাবে চেনা যায়:-


১) লান্দে কবিতা দুলাইনে সীমাবদ্ধ থাকবে।  তার পেরিফেরিতে থেকেই সাহিত্যমান বজায় রেখে একটা সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করবে। অর্থাৎ প্রতি জোড়া লাইন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা।


২) লান্দের প্রথম লাইনটিতে যে কোনো ছন্দে ৯ মাত্রার শব্দ থাকবে এবং দ্বিতীয় লাইনে ১৩ মাত্রার শব্দ থাকবে।


৩) এর বিষয়বস্তু হবে প্রেম, দেশপ্রমে, যুদ্ধ, নির্বাসন, মনস্তাপ ।


৪) লান্দে ব্যঙ্গ বিদ্রোপের মাধ্যমে রূঢ় সত্যকে তুলে আনে।


৫) লান্দের কোন সুনির্দিষ্ট মিল বিন্যাস নাই। তবে প্রতি চরণ শেষ করা হয় ‘না’ এবং ‘মা’ ধ্বনিতে। এটি পশতু ভাষার শব্দের এক বিশেষ দিক। বাংলায় এমনটি করা দূরহ এবং প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না।


     পরিশেষে বলা যায়, ঐতিহ্যবাহী পশতুন লোককাব্যের অনন্য এক কাঠামো ‘লান্দে’। এর শক্তিতে ভীত হয়ে তালেবানরা তাদের অধ্যুষিত এলাকায় চর্চারত নারী কবিদেরে নিবর্তন করে আসছে। আসুননা এর পেরিফেরিতে থেকে লিঙ্গ নির্বিশেষে লান্দে লিখে বাংলা কবিতাকে বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তুলি। দেখুনতো নিচের কবিতাগুলো ‘লান্দে’ হিসেবে কতটা স্বার্থক।


রহমান মুজিবের লান্দে


*
রুষ্ট ওচোখ বকলো– নিকামা
জানে না শুধু সে, ওচোখ আমার ঠিকানা।
*
সে জন   রস পিয়াসী মর্দ না
দেখে   যে পারে না নারীর চোখের তর্জমা।
*
মধুর ঘাঁটি দেশের মাটি -মা
শ্যামল বুকে রইব সুখে কোথাও যাব না।
*
বাংলার মাটি জাগায় নেশা মা
যে দিকেই চোখ যায় দেখি, সবুজের নিশানা।
*
পাখিদের লাগে না সীমানা
আচানক সেরা জীব মানুষে তা মানে না।


     একটা কাঠামো নিয়ে নিবিড় চর্চা করা হলে সাফল্য আসতে বাধ্য। অসুন হাত মিলাই।


তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল।