কবিতা কি এবং কেন? কেমন হওয়া উচিত কবিতা? প্রশ্নটিগুলো পুরোনো । অনেক কবি, দার্শনিক, চিন্তক, সমালোচক রহস্যময়ী কবিতার রহস্য উন্মুচনে সচেষ্ট ছিলেন, আছেন ভবিষৎতেও থাকবেন। ইনাদের কেউ বলেছেন ‘শব্দই কবিতা’, কেউ বলেছেন উপমাই কবিতা, কেউ জোর দিয়েছেন রূপকের দিকে। কেউ বলেছেন ‘Right word in right order’ অথাৎ যথাশব্দ যথাস্হানে ব্যবহার করা । কেননা শব্দের সুষ্ঠু বিন্যাসই কবিতাকে সেই সামর্থ্য এনে দেয়, যা থাকলে একটি কবিতা বা তার অংশবিশেষ প্রবলভাবে আমাদের মনকে নাড়া দেয় । কবিতা চেনার বিষয়ে শ্রী আনন্দবর্ধন বলতে চেয়েছেন, যে-বাক্যবদ্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমারা লাভ করতে পারি না, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই। হালে কবিতার সুবোধ্যতা দুর্বোধ্যতা নিয়েও নানাবিদ কথা শুনতে পাই। সেদিন এক সাহিত্য সভায় আলোচক তো বাংলা কবিতার দুরবস্থার দায় একতরফা ভাবে কবিতার দুর্বোধ্যতার ঘাড়ে বসালেন। শুনে প্রশ্ন উদয় হলো মনে, চর্যাপদের ভাষা কি তৎকালিন প্রচলিত ভাষা থেকে আলাদা ছিল না? লোরকার দুয়েন্দে, কাফকার কাফকায়েস্ত এগুলো কি জলবৎ তরলং ছিল? তাহলে  ভূগোলের বাধা পেরিয়ে এগুলো হতিহাস হলো কি করে? মনেতো হয় একটা কবিতা কবিতা হয়ে উঠল কিনা, মনকে ছুয়েঁ গলে কিনা তাই মূল কথা। কথাগুলো ভাবছিলাম কবি স্বপন কুমার দাস এর ‘লেহন’ কবিতা ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা পাঠ করে। বুঝে নিতে চাইলাম এর মূল সুর।


“প্রজননহীন সময়ের লেহন শরীরে শরীরে
মুদ্রিত কোরকে মন তোমারই কাছে গচ্ছিত ছিল।
সূর্যাস্তের শিরিণ সবায় নতজানু হয়ে..
যুগে যুগে তোমার তরঙ্গায়িত হবার কাহিনী শুনেছি,
কারন তুমি দেখেছো এ প্রথিবীকে সহস্রচোখে।
অতৃপ্তির আকরে ঝলসান প্রেম জীবনের কিনারায়..
একদিন উথ্থিত হবে বিদীর্ন বীজ।
ভারসাম্যহীন তরলতায় ভেসে আছে পৃথিবী গোলক।
আজ গন্তব্য স্হির নয়, তবুও একদিন পৌছে যাবো।
সাহসীর মৃত্যু লেখা থাকে শুধু কোন যুদ্ধক্ষেত্রে”।


          উত্তপ্ত এ সমাজে বসবাস করে যাপিত জীবন এবং বোধনের আলোকে কবির মনে হয়েছে পৃথিবীর মানুষ যেভাবে বর্তমান সময়টা অতিবাহিত  করছেন তা যেন শান্তি ও মানবতার জন্য প্রজননহীন। দিকে দিকে বিভিন্ন মধুর বুলি কপচিয়ে মানবতাকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু তাঁর প্রতিতী আধুনিক সময়ের কোরক তথা শুভ দিকগুতেই গচ্ছিত ছিল। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ধ্যানি শিক্ষার মিষ্টিমূহুর্তগুলোতে কবির নজরে এসেছে সময়ে সময়ে নানা অর্জনে সভ্যতা তরঙ্গিত হবার ইতিহাস । কবি এবার সময়কে ব্যাক্তিয়ায়ন করে দুনিয়ার নানা ঘটনার দ্রষ্টা হিসেবে যথার্থ ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন পৃথিবীব্যাপি অতৃপ্তি-বঞ্চনার খনিতে যে প্রেম ঝলসে গেছে, সে প্রেমের বীজ আবার উথ্থি হবে। কবির মনে হয়, পৃথিবী ধনি-নির্ধন, জালেম- মজলুম ইত্যাকার নানা বিবেধে ভারসাম্যহীন, টলায়মান এর  লক্ষ যেন স্হির নেই, গন্তব্য জানা নেই।কিন্ত তিনি আশাবাদী একদিন ঠিকই গন্তব্যে পৌছুতে পারবেন। শেষ চরণে কবি ত্রাতা হিসেবে সাহসী লোকদের উৎসাহিত করেছেন এ সংগ্রামে আমরণ লড়াই করার জন্য। কেননা পৃথিবী কেবল যুগ সৃষ্টিকারীগণকেই মনে রাখে। এভাবে বুঝে নিয়ে বেশ ভাল লেগেছে কবিতাটি।


একটি দিক অবশ্য খটকা লেগেছে। কাবতাটির শুরু নেতিবাচক বিষয়ের উপস্থাপনা দিয়ে। কিছু বর্ণনার পর “একদিন উথ্থিত হবে বিদীর্ন বীজ”। বক্তব্যে আশার কথা শুনানো হল। অতপর “ভারসাম্যহীন তরলতায় ভেসে আছে পৃথিবী গোলক”। আবার নেতিবাচক দিকে নিয়ে যাওয়াটা মনের সায় পেল না। কবি ভেবে দেখবেন।


আমরা এখানে যেভাবে ভাবলাম, কবি হয়তো সেভাবে  নাও ভাবতে পারেন । ওতে কিছু যায় আসে না । Multi Text কবিতার ঐশ্বর্য্য । তাই বোধ করি কবি আল মাহমুদ রহস্যময়ী কবিতাকে মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েসা আক্তারের সাথে তুলনা করেছেন । পাঠক হিসেবে আমরা আমাদের চিন্তা-চেতনা-শিক্ষা-রুচির ভিত্তিতে কবিতাটি বুঝে নিতে চাইব । এভাবেই কবির মৃত্যু এবং পাঠকের জন্ম ঘটে।আজকের দিনে পাঠক শুধু পাঠকই নন, একজন বিশ্লেষকও বটে।  আসুন কবিতার দীক্ষিত পাঠক হয়ে আয়েসা আক্তারের মন পেতে সানন্দে পথ হাঁটি ।
সুতরাং এবার বলা যেতে পারে, লেহন সময়ের সাহসী উচ্চারণ। সুন্দর কবিতার জন্য কবিকে অভিনন্দন।


বিশেষ দ্রষ্টব্য:
কবির প্রতি: শিরিণ> শিরিন, কারন> কারণ, বিদীর্ন> বিদীর্ণ । মোট তিনটি বানান বিভ্রাট। এমন গভীর ভাবের কবিতায় এবং সপ্তাহের বাছাই করা কবিতা হিসেবে স্থান পাওয়ার পরও বানান ভুল থেকে যাওয়া নেতিবাচক বার্তাই বহন করে।


এডমিনদের প্রতি: কোন কবিতা সপ্তাহের বাছাই করা কবিতা হিসেবে স্থান দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট কবির মাধ্যমে বানান এডিট করিয়ে নিয়ে  অতপর করা যেতে পারে। অন্যথায় বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।