তের্জারিমা (Terza Rima) কাব্যরীতির সূতিকাগার ইতালিতে । বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান কবি দান্তে আলিগিয়েরি (Dante Alighieri 1265-1321 )  তাঁর ‘ Divina Commedia’  নামক অনন্য মহাকাব্যে এ  কাঠামোটি (from) ব্যবহার করেন। সম্ভবতঃ প্রোভেনসাল ট্র্যাবুডর্স ব্যবহৃত একটি গীতিকা ফর্ম ‘সিরভেন্টস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই ফর্ম প্রণয়ন করেন। এই ফর্ম তৈরিতে কবি Holy Trinity বিষয়টিও কাজ করে থাকতে পারে। দান্তে দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পেত্রার্কে, বোক্যাক্সিও এবং অন্যান্য ইতালিয়ান কবিগণ এই ফর্ম কাব্য রচনা করেন। সনেটের মতো এটিও এক গভীর ভাব প্রকাশক কাব্য কাঠামো। ইতালিয়ান Terza Rima শব্দের দুটি অংশ । Terza = third বা তিন, Rima= rhyme বা অন্ত্যমিল/মিল/ অন্ত্যানুপ্রাস।


তের্জারিমার সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে উইকিপিডিয়ার দ্বারস্ত হয়ে জানা যায়, “Terza rima is a three-line stanza using chain rhyme in the pattern a-b-a, b-c-b, c-d-c, d-e-d. There is no limit to the number of lines, but poems or sections of poems written in terza rima end with either a single line or couplet repeating the rhyme of the middle line of the final tercet. The two possible endings for the example above are d-e-d, e or d-e-d, e-e.”


অতএব, তের্জারিমা হচ্ছে এমন এক কবিতা কাঠামো যেখানে তিন লাইনে এক একটা স্তবক রচিত হয়। একটি স্তবক অপর স্তবকের মিলের সাথে এক শিকলে বাঁধা পড়ে। প্রতিটি স্তবকে প্রথম ও তৃতীয় লাইনে সমমিল থাকে কিন্তু দ্বিতীয় লাইনটি থাকে নিঃসঙ্গ। এই দ্বিতীয় নিঃসঙ্গ লাইনটি সঙ্গ খুঁজে পায় পরবর্তী স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় লাইনে। এভাবে রাখি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিনুনী কেটে কেটে স্তবকের পর স্তবক রচিত হতে থাকে। তের্জারিমার অন্ত্যমিল কাঠামো কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ... । এভাবে চলতে থাকে। এর চরণ সংখ্যার কোনো নির্ধারিত সীমা নাই। কিন্তু বক্তব্যরে প্রয়োজনে শেষ তো করতে হবে। শেষ করার দুটি উপায় ১) সর্বশেষ স্তবকের মধ্যলাইনের অন্ত্যমিলের সাথে মিল রেখে অরো একটি লাইন যুক্ত করা। যেমন- ‘কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ, চ’। অর্থাৎ শেষ স্তবকটি চার লাইনের। দান্তে নিজে এটি ব্যবহার করেছেন। ২) সর্বশেষ স্তবকের মধ্যলাইনের অন্ত্যমিলের সাথে মিল রেখে অরো দুটি লাইন যুক্ত করা। যেমন- ‘কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ,চচ’। এটি করেছেন ইংরেজ কবি  শেলী ( Shelley) । তিনি আলোচ্য Terza Rima কাঠামোতে ১৪ লাইনের সনেট লিখতে গিয়ে এমনটি করেছিলেন। রবার্ট ফ্রস্ট তাঁর সনেটের সমাপ্তিতে অন্য রকম মিল ব্যবহার করেন। তা হচ্ছে ( কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙ ক ) বা (A,b,a bcb, cdc, dad, aA)  তাহলে বুঝা গেল তের্জারিমায় সবশেষে ঘটে মধুর মিলন । নিঃসঙ্গ লাইন আর থাকে না। মধুরেণ সমাপয়েত।


ইংরেজ কবি জ্যফ্রে চৌসায়ার তার “Complaint to His Lady” তে প্রথম এ ফর্মটি প্রয়োগ করেন তারপর মিল্টন, বায়রন, শেলি ,থমাস হার্ডি  এবং বিশ শতকে টি এস এলিয়ট, রবার্ট ফ্রস্ট, এলিজাবেথ জেনিংস, ফিলিপ লারকিন, জেমস ম্যারিল, ডেরেক ওয়ালকোট, এডওয়ার্ড লবারি ,রিচার্ড উইলবার সহ আরো অনেক ইংরেজ কবি তের্জারিমা (Terza Rima) নিয়ে কাজ করেছেন। এডওয়ার্ড লবারি ছয় সিলেবলের (syllabled ) লাইনে তের্জারিমা  লিখেন। তাঁর এই রূপের রূপান্তরটি “পিকোলো তের্জারিমা-Piccola Terza Rima” নামে পরিচিত।


নিচে তিনটি তের্জারিমা (Terza Rima) ফর্ম এ লেখা কবিতার নমুনা তোলে দেওয়া হলো:
১.


“ Nel mezzo del cammin di nostra vita (a)
mi ritrovai per una selva oscura (b)
ché la diritta via era smarrita. (a)
Ahi quanto a dir qual era è cosa dura (b)
esta selva selvaggia e aspra e forte (c)
che nel pensier rinnova la paura! (b)
Tant'è amara che poco è più morte; (c)
ma per trattar del ben ch'i' vi trovai, (d)
dirò de l'altre cose ch'i' v'ho scorte. (c)
Io non so ben ridir com'i' v'intrai, (d)
tant'era pien di sonno a quel punto (e)
che la verace via abbandonai. (d)”   (Divina Commedia; Dante Alighieri)


২.
“O wild West Wind, thou breath of Autumn's being, (a)
Thou, from whose unseen presence the leaves dead (b)
Are driven, like ghosts from an enchanter fleeing, (a)
Yellow, and black, and pale, and hectic red, (b)
Pestilence-stricken multitudes: O thou, (c)
Who chariotest to their dark wintery bed (b)
The winged seeds, where they lie cold and low, (c)
Each like a corpse within its grave, until (d)
Thine azure sister of the Spring shall blow (c)
Her clarion o'er the dreaming earth, and fill (d)
(Driving sweet buds like flocks to feed in air) (e)
With living hues and odours plain and hill: (d)
Wild Spirit, which art moving everywhere; (e)
Destroyer and preserver; hear, oh, hear! (e)”   (Ode to the West Wind; Shelley) এটি একটি সনেট।


৩.
I have been one acquainted with the night.
I have walked out in rain—and back in rain.
I have out walked the furthest city light.
I have looked down the saddest city lane.
I have passed by the watchman on his beat
And dropped my eyes, unwilling to explain.
I have stood still and stopped the sound of feet
When far away an interrupted cry
Came over houses from another street,
But not to call me back or say good-bye;
And further still at an unearthly height,
One luminary clock against the sky
Proclaimed the time was neither wrong nor right
I have been one acquainted with the night.   (Acquainted with the Night;Robert Frost এটিও সনেট)

বাংলা ভাষায় প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)  প্রথম তের্জারিমা রচনা করেন ।  এ সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তীকে ৫/১১/৪১ তারিখে লিখিত  একটি পত্রে তিনি জানিয়েছিলেন “ Terza Rima যে কেন লিখতে গেলাম মনে পড়ছে না। ইংরেজি ভাষায়  ও জাতের কবিতা নাই। বোধ হয় B rowning  এর The Statute of the Bust ছাড়া।  আমি পরে আবিস্কার করছি যে Dante’র Divina Commedia  আগাগোড়া Terza Rima  ছন্দে লেখা। যেন ওছন্দ পয়ারের স্বগোত্র । কিন্তু আমি কথাকে ওছন্দে লেখা অসম্ভব মনে করেছি। একটি Terza Rima লিখতেই মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রতি তিন ছত্রের মধ্যে একছত্র Unrhymed থাকে, তার পরের ত্রিপদীতে তার মিল টেনে আনতে হয়। সনেট চৗদ্দ পঙক্তি লিখেই খালাস, কিন্তু Terza Rima’য় শেষ পর্যন্ত ছুটি নেই...”।


নিচে এ প্রতিভাধর কবির একটি তের্জারিমা উদ্ধৃত করা হলো:


তের্জারিমা:                                  মিল
“এদিকে সুমুখে দেখি সময় সংক্ষেপ     (ক)
রচিতে বসিনু আমি ছোটখাট তান,        (খ)
বর্ণসুর এাকাধারে করিয়া নিক্ষেপ।        (ক)


আনিনু সংগ্রহ করি বিঘৎ প্রমাণ           (খ)
ইতালির পিতলের ক্ষুদ্র কর্ণেট,             (গ)
তিনটি চাবিতে যার খোলে রুদ্ধ প্রাণ।      (খ)


এহাতে মুরতি ধরে আজি যে সনেট,       (গ)
কবিতা না হতে পারে কিন্তু পাকা পদ্য,    (ঘ)
প্রকৃতি যাহার ‘জেঠ’, আকৃতি ‘কনেঠ’।    (গ)


অন্তরে যদিচ নাহি যৌবনের মদ্য,          (ঘ)
রুপেতে সনেট কিন্তু নবীনা কিশোরী       (ঙ)
বারো কিংবা তেরো নয় পুরোপুরি চৌদ্দ।  (ঘ)
[পদচারণ: কৈফিয়ত ( Terza Rima) ছন্দে]


উপরের আলোচনার আলোকে এবার আসুন তের্জারিমার বৈশিষ্টগুলো চিনে নিতে সচেষ্ট হই:


১)  তের্জারিমায় তিন চরণের স্তবক হবে।


২) প্রতি স্তবকের ১ নং ও ৩ নং লাইন একই মিলযুক্ত হবে। ২ নং লাইনটি থাকবে নিঃসঙ্গ।


৩) ২ নং লাইনের অন্ত্যমিল অনুসারে পরবর্তি স্তবকের ১ নং ও ৩ নং লাইনরে অন্ত্যমিল দিতে হবে এবং এভাবে চলতে থাকবে।


৪) এর মিল বিন্যাস হবে  কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ...।


৫) এ কবিতার সমাপ্তি টানতে হবে সর্বশেষ স্তবকের মধ্যলাইনের মিলের সাথে মিল রেখে অরো দুটি লাইন যুক্ত করে যেমন- ‘কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ,চচ’। অথবা সর্বশেষ স্তবকের মধ্যলাইনের অন্ত্যমিলের সাথে মিল রেখে অরো একটি লাইন যুক্ত করে। যেমন- ‘কখক, খগখ,গঘগ, ঘঙঘ,ঙচঙ, চ’।


৬) এর চরণ সংখ্যার নির্ধারিত সীমা নেই।


৭) তের্জারিমা (Terza Rima) লিখার জন্য কোনো মিটারসেট বা তাল নেই, কিন্তু ইংরেজিতে iambic pentameter এ বেশিরভাগ তের্জারিমা লিখা হয়েছে। বাংলায় অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত  এ তিনটি বনেদী ছন্দেই তের্জারিমা লেখা সম্ভব।


৮) দান্তের রচিত ডিভাইন কমেডিয়া ‘Divina Commedia’ মহাকাব্যে ১১মাত্রার শব্দ দ্বারা প্রতিটি চরণ রচিত হয়েছে। তাই মৌলিক তের্জারিমা (Terza Rima) ১১মাত্রার লাইন । পরবর্তীতে ইংরেজ কবিগণ বেশি সিলেবলের তের্জারিমা (Terza Rima) লিখেছেন।


৯) তের্জারিমা (Terza Rima) কাঠামোয় ১৪ লাইনে সনেটও লিখা যায়।


এখানে আমার লিখা দুটি তের্জারিমা (Terza Rima) উপস্হাপন করা হলো:


সাপ বেজি হ্যাজি-প্যাজি


ডোরাসাপ ডেকে বলে বেজিরে
তুই বড়ো ঝগরাটে স্বভাবে
তাই তোকে ভাবি হ্যাজি-প্যাজিরে।


খুব জানি শিক্ষার অভাবে
এইমতো বলে সব ইতরে
রেগে গেয়ে বেজি বলে জবাবে।


ফোঁস করে ফূঁসে উঠে ভিতরে
সাপ বলে ছোট কান বেজাতি
বাগে পেলে করব যে কী তোরে!


অপরের ছেঁদা খুঁজে যে জাতি
দাঁতে বিষ তবু তারা গর্বে
লোক মেরে করে বিষ বেসাতি।


রোষে বেজি বলে এই পর্বে
সাপ তোর কান নাই মাথাতে
কী করে যে ওজা কান ধরবে!


নাই থাক তবু আছি যা তাতে–
মাথা তোর চুরমার করবো,
সাপ থাকে বেজিটাকে তাতাতে।


কোনোব্যাঙ ভাবে, প্যাচে পড়বো
ফাল মেরে কাছে গিয়ে ঢংগে
শেষকালে পেটে গিয়ে মরবো!


এ খেলাতো নানা রং সঙ্গে
আকসার ডাকছেড়ে ঘটছে
বহু ত্যাগে পাওয়া এ বঙ্গে
তা হবে না ব্যাঙছানা চটছে.....।


(দান্তের রীতি মেনে মাত্রাবৃত্তে ১১ মাত্রার চরণ।)


ফানা মন


কতোকাল রবো আর বলো তাঁরে ছাড়া
যে আমার বুকে মেরে চুখা বিষ তির
দুই চোখে ঢেলে গেল জলের ফুয়ারা!


বুঝেনি সে এ হৃদয়ে কতোটা গভীর
ক্ষত রেখে গেছে তার খেলো অবহেলা
একা পাখি খুঁজে মরি ঝড়েভাঙা নীড়।


পোড়াপ্রেম কবে হলো মরামাটি ঢেলা!
অথচ বেসেছি ভালো দিয়ে মনো-প্রাণ
সহে না বিরহ আর পারি না একেলা!


ও বধিরা ফিরে এসো, শোনো আহবান
নিবিড় নিরালে বসে রচি প্রেমে সুর
ফানা মন ডানা মেলে গেয়ে যাক গান।


তানে ভরা গানে গানে হয়ে নেশাতুর
দুটি মনে থাক ভেসে সুধা সুমধুর।


( শেলীর রীতি মেনে অক্ষরমাত্রিক ছন্দে সনেট। এখানে ১৪ মাত্রার চরণ।)


দান্তের Divina Commedia:- ‘Divina Commedia’ যার ইংরেজি অনুবাদ Divin Comady. বিশ্বখ্যাত এ মহাকাব্যটি দান্তে ১৩০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে রচনা করেন। মহাকাব্যটি ইনফেরানো,পুরগাতোরিও এবং পারাদিসো এই তিন পর্বে বিভক্ত । প্রত্যেক পর্বে রয়েছে ৩৩টি সর্গ । তবে ইনফেরানো পর্বে আছে ৩৪টি সর্গ এর একটি মুখবন্ধ স্বরূপ।  অনন্য এ মহাকাব্যটিতে সর্বমোট ১০০টি সর্গে  ১৪,২৩৩টি লাইন রয়েছে। প্রতিটি লাইনে রয়েছে ১১টি মাত্রার শব্দ। এই মহাকাব্যটি একটি কাল্পনিক ও রূপক কাহিনী নর্ভর। এটি স্হানীয় ভেনেশিয়ান কথ্যভাষায় লিখিত। এখানে চার্চ , সমসাময়ীক বিখ্যাত ঘটনা এবং ব্যাক্তিবর্গের প্রতি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ  আর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির সুগভীর দার্শনিক-চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। এর মূল ঘঠনা হচ্ছে,  কবি প্রেমিকা বিয়াত্রিচে মহাকবি ভার্জিলকে পাঠিয়েছেন দান্তেকে মরণ পরবর্তী জগতের পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসতে। ভার্জিল তাকে ইনফেরানো বা নরক,পুতগাতোরিও বা প্রেতভূমি দেখিয়ে পারাদিসো বা স্বর্গে পৌছে দেন। এই  পরলোক যাত্রার  নিখুঁত বর্ণনা, অন্তর আবেগ, দার্শনিক-চিন্তা, ইতিহাস ও পুরাণের অসামান্য সংমিশ্রণ  ইত্যাদির জন্যই এটি বিশ্বের কালজয়ী মহাকাব্যগুলোর অন্যতম হয়ে আছে।


উপরের আলোচনা থেকে একথা বলাই বাহুল্য, তের্জারিমা কাঠামোয় কাব্যলিখায় চ্যালেঞ্জ আছে। সফল হলে এর কার্যকারিতার প্রমাণ ‘ডিভাইন কমেডি’ । অসুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।


তথ্যসূত্র:


ক)আধুনিক বাংলা ছন্দ- নীলরতন সেন।প্রথম দে’জ সংস্করণ: আশ্বিন ১৪০২।
খ) অন্তর্জাল।