রাত বারোটা এক । লোকটা শবাসনে শোয়া । চক্ষু নির্মিলিত । ঘুমোবার পূর্বায়োজন । হঠাৎ কে যেন মাথায় সুড়সুড়ি কেটে বলে, “ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”
“কই ? না তো!” শবাসনে থেকেই লোকটা বিড়বিড় করে।


–শোন, জেগে থাকো । কথা বলতে হবে ।
বুড়ো, আবার এসেছো জ্বালাতে! তোমার স্পর্শেই বুঝতে পেরেছি । জলদি ভাগো! এখন ঘুমোব ।


–না, ঘুমালে হবে না। ওঠো কাজ করতে হবে, মজার কাজ ।


আবার সেই পুরনো ছন্দের কথাই বলবে তো? তুমি কি দেখো না লোকে কেমন ঠোঁট বাঁকায়?


–তাতে কী যায় আসে! তুমি লেখ…


“জলের পুকুর
মেঘের মুকুর
মেঘ দেখে তার মুখ
মেরে উঁকি
দেখে খুকি
দেখায় দারুণ সুখ”।


–লিখেছো?


হ্যাঁ, লিখেছি ।


–আচ্ছা বলোতো, তুমি বাংলাভাষার কয়টি ছন্দের নাম জান?


কী হলো বুড়ো! তুমি রাতদুপুরে ভাইভা বোর্ড বসালে নাকি?


–আরে চটছো কেন? বলোই-না।


এ..এ..এইতো–স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, মিশ্রছন্দ, গদ্যছন্দ, স্বরমাত্রিক, স্বরাক্ষরিক, অক্ষরমাত্রিক । আর এসব ছন্দের ভিত্তিতে মহাজন কবি-সাহিত্যিকগণ গড়ে তুলেছেন  অমিত্রাক্ষর, পয়ার, মহাপয়ার,গজল ইত্যাদি । এছাড়াও বিশ্বের  বিভিন্ন  প্রান্তের  কিছু কাব্য কাঠামো বা কাব্য ফর্ম এদেশের কিছু মহান কবি, ছড়াকার আত্তীকরণ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন । যেমন: সনেট, লিমেরিক, হাইকু, তানকা, রুবাই, ক্লেরিহিউ, ইত্যাদি । এগুলো বিদেশী ফুল । আর কদিন আগেইতো তোমার যন্ত্রণায় লিখা হলো এ মাটির পথে গজানো বনফুল ‘রমুছাঁচ’।  যদি বলো, একেও না হয় ধরে নেয়া যায় । হয়তো আরো কারো কোন কাঠামো আছে, তাও ধরে নেয়া যাবে।  হলোতো?


–আচ্ছা শোনো, এবার  আমি কোনো কাব্য ফর্মের কথা বলতে আসিনি । এবার অন্য কিছু হবে । উপরের ছড়াটার ছন্দ বিশ্লেষণ করে দেখাওতো । প্রথমে স্বরবৃত্তে করবে ।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                ।  –    । –
জলের পুকুর
।  –    । –
মেঘের মুকুর
–    । ।    –    –
মেঘ দ্যাখে তার /মুখ
।  ।    । ।
মেরে উঁকি
।  ।    । ।
দেখে খুকি
।  –    । –    –
দেখায় দারুণ /সুখ।


  যেহেতু স্বরবৃত্ত ছন্দে মুক্ত ও রুদ্ধ উভয় সিলেবল এক মাত্রার মূল্য পায় সেহেতু এখানে প্রতি পূর্ণপর্বে ৪ মাত্রা এবং অপুর্ণ পর্বে  ১  মাত্রা রয়েছে । এর মাত্রা বিন্যাস  ৪/ ৪/ ৪/ ১ // ৪/ ৪/ ৪/ ১ একুনে ২৬ মাত্রা । হয়েছে?


– এবার মাত্রাবৃত্তে একে বিশ্লেষণ কর ।


।  –   । –
জলের পু/কুর
।   –    ।  –
মেঘের মু/কুর
–    । ।    –    –
মেঘ দেখে/ তার মুখ


। ।   । ।
মেরে উঁকি
।  ।    । ।
দেখে খুকি
।  –    ।  –   –
দেখায় দা/রুণ সুখ।


আমরা জানি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্ত সিলেবল এক মাত্রা এবং রুদ্ধ  সিলেবল  শব্দের যেখানেই থাকুক দুই মাত্রার মূল্য পায় । সেবিচারে এখানে প্রতি পূর্ণপর্বে  ৪ মাত্রা এবং অপুর্ণ পর্বে ২ মাত্রা রয়েছে ।  মাত্রা বিন্যাস  ৪, ২ / ৪, ২ / ৪ / ৪ // ৪ / ৪ / ৪ / ৪ একুনে ৩৬ মাত্রা । অবশ্য ৬, ৬, ৬, ২ /  ৪, ৪, ৬, ২ এভাবেও মাত্রা বিন্যাস  হতে পারে । এ তো দেখছি স্বরমাত্রিক ছন্দে রচিত । এ আর নতুন কি ?


– এবার একে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বিশ্লেষণ কর ।


বল কী বুড়ো! তোমার মাথায় গোল বেঁধেছে বুঝি! একই ছড়া-কবিতাকে তুমি তিন ছন্দে বাঁধতে চাও?


– আচ্ছা করেই দেখো না, হতেওতো পারে ।


।  –    । –
জলের পুকুর
।  –    । –
মেঘের মুকুর
  –    । ।    –    –
মেঘ দেখে তার / মুখ
।  ।    । ।
মেরে উঁকি
।  ।    । ।
দেখে খুকি
।  –    । –    –
দেখায় দারুণ /সুখ।


যেহেতু অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মুক্ত সিলেবল এক মাত্রা এবং রুদ্ধ সিলেবল শব্দের আদিতে বা মধ্যে থাকলে এক মাত্রা আর অন্তে বা শেষে থাকলে দুই মাত্রা এবং এক রুদ্ধ সিলেবলের শব্দ দুই মাত্রার মূল্য পায় সেহেতু এখানে প্রতি পূর্ণপর্বে  ৪ মাত্রা এবং অপুর্ণ পর্বে  ২ মাত্রা রয়েছে ।  মাত্রা বিন্যাস  ৪, ২ / ৪, ২ / ৪ / ৪ // ৪ / ৪ / ৪ / ৪ একুনে ৩৬ মাত্রা ।   এ তো দেখছি অক্ষরবৃত্ত ছন্দেও ঠিকঠাক! অর্থাৎ কিনা এটি স্বরমাত্রিক, স্বরাক্ষরিক, অক্ষরমাত্রিক বা মাত্রাক্ষরিক ছন্দেও সিদ্ধ!  অন্য একটি দৃষ্টান্ত দাও।
-“নাচে যখন আকিরা
           চেয়ে থাকেন বাকিরা
            নাচের তালে
            গাছের ডালে
           গেয়ে ওঠেন পাখিরা”।


এবার ভাবো বিষয়টা । তুমি ছড়া বা কবিতা লিখলে একটা আর এতে রংধনুর রঙের মতো ছন্দ লুকানো সাতটা! মজার না!


কিভাবে ? বুঝলাম নাতো, একটু বুঝিয়ে বলবে প্লিজ!


–তুমি  মাথা মোটা, জানতাম । কিন্তু এতটা, তা তো জানতাম না! আচ্ছা দেখ, এখানে তুমি বাংলা ভাষার মৌলিক তিনটা ছন্দ স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত পেয়ে যাচ্ছ । অন্যদিকে বাংলা ভাষার তিনটা যৌগিক ছন্দ স্বরমাত্রিক, স্বরাক্ষরিক, অক্ষরমাত্রিক বা মাত্রাক্ষরিক এ তিনটা ছন্দও এর জালে আটকা পড়েছে, তাইনা? সুতরাং ৩+৩=৬ আর এ সবগুলোর সম্মেলনে এটি নিজেই একটা ভিন্ন  ছন্দ । ফলে ৬+১ = ৭ অর্থাৎ একের ভেতরে সাত! তিন ছন্দের সহাবস্থানে কেমন সুন্দর আরও একটা যৌগিক ছন্দের উৎপত্তি হয়েছে দেখলে ! সুতরাং সাত সুরে মালা গেঁথে, সাত পাঁকে বাঁধার মতো বেঁধে রঙধুনুর সাত রঙে সাজিয়ে এগিয়ে যাও মুক্তির মানসে ।


আচ্ছা, এটা কি নতুন কিছু?


–না, তা হয়তো নয়।“ত্রিমা‌ত্রিক ছ‌ন্দ” নামে এর অল্প প্রচলন আছে। কিন্তু বাংলা ছন্দেই ‘মাত্রা’ শব্দটির ভিন্ন ব্যবহার আছে। বিজ্ঞানেও “ত্রিমা‌ত্রিক” শব্দটিরও ভিন্ন ব্যবহার আছে। তাই চলো এখানে আমরা আমাদের চিন্তাটুকু যোগ করি  । চলো নাম নিয়ে ভাবি ।

সপ্তমুখী ছন্দ  নাম দিলে কেমন হয়?


- ওম… না । ধারাবাহিকতা নাই । কেমন একর ভেতরে সাতের  মতো লাগে ।


তাহলে… তাহলে  নাম দিয়ে দাও স্বরাক্ষরমাত্রিক ছন্দ বা ত্রিবৃত্ত ছন্দ । এতে ধারাবাহিকতা পাবে । ত্রিবৃত্ত ছন্দ  নামটা ছোট । অগ্রাধিকার দিতে পারো ।
            অকস্মাৎ লোকটার কানে এসে বাজে ‘আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম’। ঘুম হতে নামাজ উত্তম ।  


যশোর
১০.৯.২০১৭ খ্রিঃ