প্রতিদিনের মতো আজও ব্যস্ততা
আর ক্লান্তির কাঁধে কাঁধ রেখে
অফিস থেকে ফেরা।
পার্থক্য কেবল এই; আজ মাইনে হলো।
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালবো বলে শীঘ্র ঘরে ফেরা,
অতঃপর ফিকে হয়ে আসা পর্দাগুলো
রং খসে পড়া দেয়ালে আমার
নিঃসঙ্গ আর একাকী প্রতিচ্ছবি;
এলোমেলো অগোছালো টেবিল,
কুঁচকে থাকা বিছানার চাঁদর
আর তুলো দেবে যাওয়া বিনম্র বালিশটাকে.
অসহ্য মনে হলো।
নাহ‍! পরিবর্তন চাই
এ আসবাব-এই দীনতা, এই একাকীত্বের।


খুব সকালে জেগে উঠি
সব বদলে দেবো বদলে নেবো
দীনতা, জরাজীর্ণতা আর নয়
চাকচিক্যে পরিপূর্ণ থাকবে চারপাশ।
বাজারের সবচেয়ে উন্নত দোকানের
উন্নত বেড সীট, সঙ্গে নতুন বালিশ,
ঘড়ের এক পাশে টাঙাবো বলে
দামী এক ঝালর বাতি;
নতুন টেবিল ক্লথ, দরজা ও জানালার
জন্য পর্দা আর পা-পোশ আমার সাথী হলো।


ঘরে এসে লণ্ডভণ্ড করি
পুরাতন আস্তাবলের মতোন ৬ বাই ৮ ফুটের ঘরখানি
দীর্ঘদিনের সঙ্গী হয়ে থাকা
জরাজীর্ণ আসবাব আর আনুষঙ্গিক
ছুঁড়ে ফেলি ঘরের এক কোণে।
সেখানে স্থান পায় নব্য ক্রয় করা
চাকচিক‌্যের আর বিলাসিতার সামান।
গোছালো পরিপাটি করে তুলি,
ছাদে ঝুলন্ত ঝালর থেকে
মৃদু আলোতে মনে তৃপ্তি এলো,
নিজেকে নিজেই বলি, বদলে দিলাম তো!!"
সমস্ত দিনের পরিশ্রম শেষে
ক্লান্ত শরীর বিছানায় লুটিয়ে পরে
কেবল চোখ জুড়ে ঘুম নেই।


হঠাৎ যেনো মনে হলো কারা কাঁদছে।।
চিকন-মোলায়েম অথচ স্পষ্ট,
মনে হচ্ছে, স্তুপাকারে জমিয়ে রাখা
দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত জিনিসগুলো
কেঁদে যাচ্ছে, প্রথমে ধীর এবং
ক্রমান্বিত উর্ধ্বমূখী তাদের কন্ঠ;
অস্বাভাবিক চিৎকারে ধমকে উঠি
চোপ-একদম চোপ। তোরা কাঁদছিস কেনো?
প্রত‌্যুত্তর আসে, সুখ-দুঃখের এতোদিনের সাথী
আজ তোমার পর হয়ে গেলো?
বুকের গভীরে তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিধে
মাথার ভেতরে শুরু হয় যন্ত্রনা।
চোপ, চুপ কর।
কানদুটো দুহাতে চেপে চিৎকার দিই
মুহুর্ত দু কি তিন
এরপর হাত সরাই কান থেকে,
ওরা থেমে গেছে,
আমি ঘুমাতে চাই, আয় ঘুম।


এরই ফাঁকে মনে হলো তীক্ষ্ণ স্বরে
বাতাস কাঁপিয়ে কেউ হাসছে,
তার সাথে যুক্ত হয় আরও কেউ
তারপর আরও কেউ, সমস্বরে।
ঝট করে উঠে বসি
অস্থিরতা বাড়ে; বাড়ে হৃদকম্পন।
টের পাই আমার কেনা ঝালড়ের
প্রতিটি মুক্তোদানা থরথরে কাঁপছে আর হাসছে।
বিছানার চাদর আর বালিশ করছে উপহাস,
পর্দাগুলো, টেবিল ক্লথ করে বিদ্রুপ।
ক্ষেপে গিয়ে উঠে দাড়াই, ধমকে দিই।
এ কী হচ্ছে, তোমরা থামবে?
আমি একটু ঘুমেবো।
ঝালরখানি রিনিঝিনি শব্দে
হেসে ওঠে বলে--
ঘুমাতে পারবে? এই একাকীত্ব
নিঃসঙ্গতা-জীর্ণতাকে নিয়ে?
প্রতিবাদ করে উঠি
কোথায় জ্বরা-কোথায় জীর্ণতা
পুরানো সব ফেলে
নতুন করে সাজিয়েছি।
অট্টহাসিতে মেতে উঠে ঝালর
সঙ্গে জানালার পর্দা, বিছানার চাদরও;
হঠাৎ কঠিন স্বরে বলে ঝালর
ওরে মূর্খ! পেছনে ফিরে চাও
আমি পেছনে ফিরি
দেখি ঝালরের নিয়ন আলোায়
রংচটা সেই পুরোনো দেয়ালে
আমার সেই প্রতিবিম্ব প্রতিচ্ছায়া
একা।
বালিশখানা বলে ওঠে
বাহ্যিক পরিবর্তন করেছো
তোমার ভেতরের শূন্যতা?


গভীর রাতের সেই প্রতিচ্ছবিটা
বুকের ভেতরে তীক্ষ্ণভাবে বিদ্রুপ করে,
মনে পড়ে যায়; সব কিছুর মাঝে
সত্যি আমি এখনো এই নিঝুম রাতে
একলা-একেলা।।
ওদিকে ওদের তাচ্ছিল্যের হাসি বেড়েই চলে।
অসহ্য মনে হয় সব
মাথার উপড়ের ঝালরটাকে
দুহাতে আছড়ে ফেলি মাটিতে
ছিন্নভিন্ন হয় সে;
পর্দাগুলোকে একটানে খুলে আনি
বিছানার চাঁদর, দামী বালিশটাকে
একত্রিত করে দেয়াশলাইয়ের
বারুদে জ্বালিয়ে দিই।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে ওরা
মুহুর্তে সব নিরব নিস্তব্ধ।


তখন আমি খুব ক্লান্ত
হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়া
পুরোনো দীর্ঘদিনের পরিচিত
জীর্ণশীর্ণ দলাপাকানো
জিনিসগুলোর কাছে যাই,
তখন ওদের খুব আপন মনে হয়;
সত্যিই তো অনেকগুলো সময়
অনেক মুহুর্ত
আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম
অথবা ওরা ছিলো আমার সঙ্গে।
ওদের ছুঁড়ে ফেলে কী  লাভ!
যদি আমার নিঃসঙ্গতা আমায়
আঁকড়ে থাকে?


ঘুম চাই, নিশ্চুপ নিরবতায়
চোখের কোনে জমে উঠে অশ্রুফোঁটা;
মনে হলো ওরা আমাকে ডাকছে,
এসো আমাদের বুকে এসো,
আমি কাপড়গুলো কুণ্ডলী পাঁকিয়ে
মাথা রাখি ওদের দেহে খোলা মেঝেতে
মনে হলো ওরা আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে
ওরা যেন গুনগুনিয়ে গেয়ে যাচ্ছে
"ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো
খাট নাই পালঙ্ক নাই , যাদুর চোখে বসো"
ওদের সুর মিশ্রিত কন্ঠের ছন্দে
আমার দু'চোখে নিদ্রারাজ্যের
সব কটা পরী যেন
এসে আসন পাতলো।


২০.০৪.২০১৪