'এই! তোমারে আমি খুব ভালোবাসি', কবি যবে কহিলে
উত্তরে তুমি বিভ্রাট নারী নিশ্চুপ রহিলে,
তাকালে এমনে ঘাড়টি বাঁকিয়ে যেন গো করেছি পাপ
তারি ব্যথা ভারে কুন্ঠিত তব প্রাণেতে লাগিল তাপ,
তবু না কবির চেষ্টা ফুরায় ডাকিছে আবারো আসি
ভেতরে তাহার ভীষণ 'কন্ঠা, মুখেতে যদিও হাসি,
কয় কবি, 'মোর জ্বালাতন যবে এতোদিনে সহিলে
তবে এই শেষবার শুনে যাও', তুমি নিশ্চুপ রহিলে।
-
ভ্রুক্ষেপ না করিয়া সেদিকে কবি ডাকে, 'প্রিয়তমা
আমি কবি বড়ো আলাভোলা, তুমি করিয়া দিওগো ক্ষমা,
তোমার জন্য স্বর্গ রচেছি, গেঁথেছি হৃদয়ে ফুল
ছন্দে গেঁথেছি মুনহার মালা, কানেতে কানের দুল,
মালঞ্চভূমে প্রাসাদ গড়েছি, যদিও স্বপ্নে আঁকা
মোর স্বপ্নের মতো স্বপ্ন কভূ কি গিয়াছে দেখা,
রাশি-রাশি সব সম্পদ হৃদে করিয়া রেখেছি জমা
আমি কবি যদি ভুল থাকে কিছু, করিয়া দিওগো ক্ষমা'।
-
এতো যে কহিছি, কিছুই বোঝনা, নীরবে বাঁধিছ কেশ
তোরে লয়ে যতো বন্দনা করি, তারো আছে পরিশেষ,
তবুওতো শেষ হয় না তোমার ব্যস্ত থাকার ভান
চেয়ে দেখো আমি এদিকে একেলা করিতেছি অভিমান,
গগনের তলে আমি কবি ছুটি শুধুযেগো তোর পিছুতে
মনতো ভরে কিছুতে আমার, মনতো মানে না কিছুতে,
যাই করো তুমি থাকে ওগো মোর হৃদয়ে তাহার রেশ
শুধু তোরে লয়ে যতো স্বপ্ন রচনা, তার নাই পরিশেষ।
-
এইবার তুমি তাকালে এদিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে ঘাড়
এমন দৃষ্টি এড়াবে কে বলো, সাধ্য আছেগো কার,
কেশ বাঁধা বাকী রেখে দিলে তুমি, আরো কিছু বাকী আছে
কবি ভাবে, এই-এইবার মোর দুঃখ আছেগো পাছে,
মুখ দেখে তব যায় নাতো বোঝা, মুখেতে কি ভাব রাখো
শান্ত তোমার যেমন চেহারা, রাগিলে তেমনি থাকো,
আমি কবি ভয়ে ভীষণ ভীত, পাবো না আজিকে পার
তোমার দৃষ্টি এড়াবে কে বলো, সাধ্য আছে গো কার!
-
কহিলে, 'এদিকে তাকাও', তাকালাম ভয়ে ভয়ে
আরো যে কহিলে, 'থাকো তুমি তব কাব্যের খাতা লয়ে,
মুখে মুখে বড়ো ভালোবাসা যায়, আমিও বাসিতে পারি
সংসার বলে ধর্ম যে আছে, তারেতো এড়াতে নারি,
তুমি শুধু লেখো রাশিরাশি ঐ কবিতার কথামালা
এদিকে আমার চুলার আগুনে চোখেতে ধরেগো জ্বালা,
সবকিছু আমি নীরবে একেলা আজিকে যায়গো সয়ে
তুমি চুপ করে বসে থাকো তব কাব্যের খাতা লয়ে'।
-
'আজ এটা নাই, কাল ওটা নাই, বারেক ফিরে কি চাও
সংসার বলে জায়গা যে আছে, কভূও কি টের পাও,
শুধু, ভালোবাসি আর ভালোবসি, কতো ভালোবাসা দেখিলাম
গত মাসে মোর শেষ হার যবে বন্ধক রাখিলাম,
তার খোঁজ তুমি করিলে কি আজো, বড়ো বেশী ভালোবাসো
ওমা! আমি যে এদিকে রাগিয়া আগুন, তুমি দেখি শুধু হাসো',
নিজের হাসিতে পড়িয়া বিপদে, কহে কবি, 'খাতা নাও
পুড়িয়ে ফেলো সবকিছু, যদি পুড়িয়ে ফেলিতে চাও'।
-
খাতা হাতে তুমি নীরবে দাঁড়ালে, আমি শুধু কহিলোম
'কিছুতো চাই নি, ভালোবাসা চেয়ে বিপদেই পড়িলাম,
এখন থেকেই সংসার করে করিবো তোমারে সুখি
আনিবো তোমার পায়ের তলাতে সোনার চন্দ্রমুখী,
বাজারেতে গিয়ে ভরিবো থলেটা নানারুপী সম্পদে'
শুধু, দামটি লইয়া মাঝে-মাঝে আমি পড়ে যাই বিপদে,
ভদ্র-সভ্য হইয়া যখন সম্মুখে দাঁড়ালাম
মুখখানি তুমি এমন করিলে, বিপদেই পড়িলাম।
-
কহিলে, 'থাক-থাক মোর ঘাট হয়ে গেছে, করিতে হবে না কিছু
চুপ করে তুমি ওখানেই থাকো, ছাড়িয়া আমার পিছু,
কথা কহিয়াই দোষ হয়ে গেছে, অনেক কয়েছি কথা
যখন বলেছি হইয়াছো সোজা, (পরে) যথাকার তুমি তথা,
তোমার সঙ্গে ঝগড়া করিলে যাইবে দিবসবেলা
তারচে' বরং ওদিকটা যাই, কাজ আছে মোর মেলা,
তোমার সঙ্গে ঘড় পাতিয়া আর সব হলো মিছু
ভালো হবে তুমি যদি ছেড়ে দাও এখনি আমার পিছু'।
-
তব কথা শুনে স্তব্ধ হইয়া হইলাম টলমল
নিশ্চল আমি নিশ্চুপে মোর পড়িল চোখের জল,
কিছুই করি না, করিতে পারি না, বিধাতা তুমিতো জানো
আমারে দিয়াই স্বর্গের বাণী দুনিয়াতে তুমি আনো,
ঐ এক কাজে ব্যস্ত হইয়া আরতো কিছু না করি
তাই বলে তুমি যেওনাগো ছেড়ে, হাত দুইখানি ধরি,
আর লিখব না আজ থেকে কিছু, ভাবিলাম অবিচল
এইবার মোর কথা শুনে তোরও পড়িল চোখের জল।
-
'ক্ষমা করো মোরে ক্ষমা করো কবি, বলিতে চাহিনি এতো
তুমি কি বোঝনা আমি যে তোমারে ভালোবাসিয়াছি কতো,
চাইনা রাজ্য, তব কাব্যের হইয়াছি কবিরাণী'
মুচকি হাসিয়া কহিলাম, 'রাণী! আমি যে সেটাও জানি',
এইভাবে তব দিনগুলো যাবে, ফুরাবে না ভালোবাসা
তোমারে লইয়া স্বর্গ রচিব, রবে এইটুকু আশা,
চিরকাল দোঁহে বাঁধিব দোঁহেরে স্বর্ণলতার মতো
তাইতো আমরা একে অন্যেরে ভালোবাসিয়াছি কতো!