বাবা মানুষটি চরম মিথ্যুক
রণজিৎ মাইতি
-------------
জানতাম না আমার বাবা মানুষটি চরম মিথ্যুক।তখন বড্ড ছোটো,একবার বাবার সাথে গিয়েছিলাম রথের মেলায়।বাবা আমাকে ঘুগনি খাওয়ালেন,দইফুচকা খাওয়ালেন।ফেরার আগে আগে পাঁপড়ভাজা ও রোলও খাওয়ালেন।কিন্তু নিজে মুখে কিচ্ছুটি তুললেন না।বাবাকে বললাম,-"বাবা তুমি কিছু খাবেনা?" বাবা অবলীলায় বললো-"না রে,পেটটা ভালো নেই।" দেখলাম ফেরার পথে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে বের করলেন কয়েকটি খুচরো শিকি-আধুলি।পাইপয়সা গুনে গুনে মায়ের জন্যে নিলেন গরমাগরম চপ,সিঙ্গাড়া ও জিলিপি।মা আমার জিলিপি বড্ড ভালোবাসেন।বাড়ি ফিরে সেসব তুলে দিলেন মায়ের হাতে।মা জিজ্ঞেস করলো "হাঁ গো,তুমি কিছু খেয়েছো?" বাবা নির্দিধায় বললো- "হাঁ"।আমি অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাতেই বাবা কাঁচুমাচু খেলেন।


যদিও তখনও জানতাম না আমার বাবা মানুষটি চরম মিথ্যুক।তখন সবে চাকরি পেয়েছি,ইচ্ছে হলো প্রথম মাসমাইনেতে মা-বাবাকে কিছু কিনে দিই।মায়ের জন্যে একটি শাড়ি নিলাম,বাবার জন্যে ঘিয়ে রঙের  পাঞ্জাবি।যেই বাবার হাতে তুলে দিয়েছি,বাবা বললো- "কি দরকার ছিলো আমার জন্যে এতো পয়সা খরচ করে আনার,আমার তো অনেক আছে।" অথচ জানি বাবার দ্বিতীয় পাঞ্জাবি নেই,একটা তিলে পড়া পাঞ্জাবিতেই যিনি কাটিয়ে দিলেন আস্ত জীবন।


শেষ দশ বছর হাঁপানির সাথে বাবার গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিলো।এটি তাঁর মাতৃকুল থেকে পাওয়া।সিজিন চেঞ্জের সময়,বিশেষ করে শীত ও গ্রীষ্মে এখন তখন অবস্থা হতো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে হাসি মুখে বলতেন,- "ওসবের কি দরকার,বিন্দাস আছি।" অথচ মায়ের বকুনিতে নিজে লুকিয়ে লুকিয়ে যেতেন গ্রামের দাতব্য চিকিৎসালয়ে।শেষ পাঁচ বছর স্টেরয়েড নির্ভর হয়ে উঠেছিলো তাঁর জীবন।কোনো দিন নিজ মুখে বলতেন না ওষুধ শেষের কথা।বরং জানতে চাইলে বলতেন এখনো অনেকটা ওষুধ আছে।


যেদিন ঘুমন্ত অবস্থায় চলে যান তারাদের দেশে,সেদিন শ্বাসকষ্টের সঙ্গে একটু জ্বর ছিলো।রাতে ডাক্তার ডাকলাম।বাবা ডাক্তারকে বললেন,- "কি দরকার ডাক্তার,বেশ তো আছি।খোকার সব ব্যপারেই বেশি বেশি বাড়াবাড়ি।"ডাক্তার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।আমি বাবার কপালে হাত রেখে বাবার কাছে বসে থাকলাম।বাবা বললেন- "খোকা তোর তো কাল অফিস,তুই শুয়ে পড়।ডাক্তারের ওষুধে বেশ আরাম বোধ করছি।"


বাবার পীড়াপীড়িতে আমি শুতে চলে গেলাম।সকালে আমার ঘুম ভাঙলো,কিন্তু বাবার ঘুম আর ভাঙলো না।


যদিও তখনও জানতাম না আমার বাবা মানুষটি চরম মিথ্যুক।তিনি কখন বেশ আছেন,কখন মন্দ আছেন আমাদের জানতেই দেননি।হয়তো কোনও বাবাই তা জানাতে চান না।