কাঠি নিয়ে আলোচনা
কবি--বিভূতি দাস
আলোচক---রণজিৎ মাইতি
------------------------
শিল্প সাহিত্যে প্রতীকের গুরুত্ব অপরিসীম।বিদ্রোহী কবি সুকান্তের কলমে একটা দেয়াশ্লাই কাঠি কিংবা একটি মোরগ কিভাবে শিল্পের রূপ নেয় তার নজির পেয়েছি।তেমন হাজারো হাজারো নজির পাই চলচ্চিত্র,নাটক,নভেলে।গণীতশাস্ত্রে প্রতীকের গুরুত্ব মিথ।রসায়নশাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক অর্থাত্ সিম্বলের উপর। Nacl বললেই সারা পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারেন ওই যৌগটি খাদ্যলবন। এতো কথা বলার কারণ,আসর প্রিয় কবি বিভূতি দাসের কবিতা 'কাঠি'।তিনি 'কাঠি'কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমান ও অতীত সমাজ সংসারের বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সরস তুলির আঁচড়ে । দেখে নেওয়া যাক কবি কি বললেন,---


"কাঠি নাড়তে ভালো দিতে ভালো
মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে
মন সমুদ্রে বান ডেকে যায় নড়া চড়ায়
বাঁশের ঝাড় হালকা হলে।"


কবির এই বক্তব্য থেকে হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারিনা।আরে এতো একেবারে বাস্তব চিত্র ।যারা কাঠি দেন সত্যিই তারা মিষ্টি মিষ্টি কথায় দক্ষ । না হলে তো মানুষ সহজে ধরে ফেলবে এদের চরিত্র । অর্থাত্ মুখে মধু বুকে বিষ।এই যে "কাঠি নাড়তে ভালো দিতে ভালো" বলে কবি একদিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অন্য দিকে বাস্তব সমাজ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এখানেই কাব্যরসে উত্তির্ণ হয়ে যায় কবির কাব্য ভাবনা । আর পাঠক হিসেবে আমাদেরও উৎসাহিত করে পরবতী স্তবকে কবি কি বললেন জানার জন্যে । দেখলাম কবি বললেন বাঁশের ঝাড় আলগা হলেই এদের আনন্দ । কারণ কাঠি পাই বাঁশের ঝাড় থেকে ।যেহেতু ঝাড় আলগা সুতরাং সেই কাঠি ব্যবহৃত হয়েছে কাঠি দেওয়ার কাজে। অর্থাত্ রম্যতার মধ্য দিয়ে কবি তুলে নিলেন তাঁর কাব্য ফসল।


তার পর পরই কবি বললেন কারা ভালোবাসে এই কাঠি দিতে।তাদের চরিত্র প্রকাশ জরুরি হয়ে পড়লো নাগরিক হিসেবে সচেতন কবির। কারণ মানুষ যদি এই কাঠিবাজদের চিনতে না পারেন তবে এদের কাছে ঠকবেন বারবার।আসুন কবির সাথে আমরাও চিনে নিই ইতিহাস খ্যাত এই বীর পুঙ্গবদের।


"শয়তান আর ধান্দাবাজের সঙ্গী ছিলো কাঠি
এখন ধোপ দুরস্ত মাতবরের সে হয়েছে সাথী
হাতে কাঠি মুখে হাসি হরেক রকম বেশ
মহানন্দে নেত্য করে মানুষের হলে ক্লেশ
কাঠি মাহাত্য ভূবন জোড়া জীবনে মরণে
সর্বহরা ধেয়ে এলে নিত্য থাকে স্মরণে ।"


হাঁ এই সব শয়তান ও ধান্দাবাজ,যাদের সঙ্গী ছিলো কাঠি তারা এখন ধোপ দুরস্ত হয়ে মঞ্চ আলোকিত করে।এবং মাইক্রোফোন হাতে হাসি হাসি মুখে মঞ্চ মাতায় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে।মানুষ এদের কাঠির ঠেলায় যতো ক্লেশ ভোগ করে এরা ততোই মহানন্দে নেত্য করে।কবি তাঁর গভীর বিক্ষণে দেখলেন এই কাঠি মাহাত্ম্য শুধু দেশে নয়,দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা ভূবন জুড়ে চলছে । এখানে লক্ষণীয় যাঁরা কাঠি দেন কবি তাদের পক্ষে নন বলেই ব্যঙ্গাত্মক ভাবে 'নেত্য' অর্থাত্ নৃত্য শব্দটি প্রয়োগ করলেন ।এবং শেষ স্তবকে এসে পৌঁছে গেলেন ব্যঙ্গের সর্বোচ্চ স্তরে ।


"কাঠি সেবা মহান ধম্ম হচ্ছে কালে কালে
কাঠি সত্য একনিষ্ঠ বলছে মহাকালে।"


সমাজ সচেতন কবি ইতিহাসের পথ ধরে বিচরণ করতে করতে পৌঁছে যান চরম সত্যে।সত্যিই ভাবতে কষ্ট হলেও স্বীকার করতেই হয় সত্য ।তিনি দেখেন শুধু বর্তমান নয় মহাকালের পথে কালে কালে চলছে কাঠি সেবা।তাই যেনো কাঠিবাজদের ধম্ম ।'ধম্ম' শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে কবি কাঠি বাজদের তাচ্ছিল্য করেছেন।কারণ কবি তাদের চরম ঘৃণা করেন ।


তাই শেষ স্তবকে এসে কবি বাংলার পরিচিত তরজা গানের সুরে আসলে শুনিয়ে গেলেন নিজের বক্তব্য।এবং রেখে গেলেন সমগ্র পাঠক সমাজের কাছে গভীর প্রশ্ন । এই 'মহান ধম্ম' কি যুগে যুগে চলতেই থাকবে ?


সুন্দর বক্তব্য নির্ভর চমত্কার ব্যঙ্গ কবিতা।তবে কবিতার বক্তব্যের বাইরে গঠনগত দিক নিয়ে কয়েকটি কথা না বললে মনে হয় আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । যদিও সেই ভাবনা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। হয়তো কবি অন্য ভাবে বিষয়টি ভেবেছেন। কবিতাটি মুখ্যতঃ কবি ছন্দে পরিবেশন করতে চেয়েছেন ব্যঙ্গের মোড়কে। কিন্তু প্রথম স্তবকে মনে হলো "কাঠি নাড়তে ভালো,দিতে ভালো" নাড়তে ভালোর পর কমা দিলে পাঠকের পাঠে সুবিধা হয় ।এবং প্রথম দুটি লাইনের মাত্রার চেয়ে পরবর্তী দুই লাইনের মাত্রা বেশি মনে হলো।তাই প্রিয় কবিকে ওই দুটি লাইন ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো।নড়া চড়ায় শব্দটির কি খুব প্রয়োজন ছিল কবিবর ? ওই শব্দটি না থাকলেই ছন্দ মাত্রা ঠিকঠাক মনে হয় ।


দ্বিতীয় স্তবকে মাতব্বর শব্দটি কি মুদ্রণ প্রমাদ ?'ধোপ দুরস্ত' নয়,মনে হয় ধোপদুরস্ত হবে প্রিয় কবি।দ্বিতীয় স্তবকের তৃতীয় লাইনের সঙ্গে চতুর্থ লাইনের মাত্রা বেশি মনে হলো। এখানে 'মানুষের' শব্দটি মাত্রা বেশি হওয়ায় কারণ মনে হলো।এবং দ্বিতীয় স্তবকের শেষ দুটি লাইনের শেষ লাইনটিও মাত্রা নিয়ে ভাবার দরকার আছে মনে হলো। 'মাহাত্য' বানানটি কি সচেতন ভাবেই লিখেছেন?যেমন 'নেত্য' শব্দটি কাব্য রসের কারণে যথার্থ প্রয়োগ মনে হলো কিন্তু মাহাত্ম্য শব্দটি 'মাহাত্য' হোক কাব্য সে দাবি করছে বলে মনে হয় না । তাই মনে হয় এখানে মাহাত্ম্য শুদ্ধ ভাবেই প্রয়োগ দরকার ।


শেষ স্তবকটি নিয়ে কিছু বলার নেই। একেবারে যথার্থ মনে হলো।আগেই বলেছি তরজার আঙ্গিকে যেভাবে শেষ করেছেন তা কাব্যরসে টইটম্বুর ।


সুন্দর কবিতা । সিরিয়াস বিষয়ের উপর এমন ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ সবাই পারেন না । যা আপনি করে দেখালেন । আমরাও কাব্যরসে ভাসতে ভাসতে ছুঁয়ে গেলাম ইতিহাস ও বর্তমান ।সমাজ ও সময়কে আপনার এই পর্যবক্ষেণ নিখুঁত। শুধু আমাদের ভাবতে হবে এর থেকে মুক্তির উপায় ।


প্রিয় কবির শৈল্পিক কলম এভাবেই গর্জে উঠুক সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় এই কামনা করি।ভালো থাকুন সবসময়।খ্রিস্টীয় নববর্ষের প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই প্রিয় কবিবর ।