সৌন্দর্যের রক্ত লেগে নেই
কবি--গৌরাঙ্গ সুন্দর পাত্র
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
-----------------------
"ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।"


আসর প্রিয় কবি গৌরাঙ্গ সুন্দর পাত্রের "সৌন্দর্যের রক্ত লেগে নেই" কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের "আমার কৈফিয়ত" কবিতার উপরোক্ত এই কয়টি লাইন ভীষণভাবে মনে পড়লো।ক্ষুধার জ্বালা বড়ো জ্বালা । ক্ষুধার্ত শিশুর কাছে ফুটন্ত গোলাপের চেয়ে এক থালা সাদা মোটা চালের ভাত ও নুনের মূল্য অপরিসীম ।কবি এটা সবচেয়ে ভালো বোঝেন বলেই তাই তো তিনি বললেন---


"হাঘরে হাভাতে শিশুদের ডেকে
হাতে হাতে ধরিয়ে দেবো ফুটন্ত গোলাপ
এমন আহাম্মক আমি নই।"


তিনি জানেন ক্ষুধার কাছে সৌন্দর্য বড়ো অসহায় । ফুটন্ত গোলপ মলিন,পূর্ণিমার চাঁদও তখন ঝলসানো রুটি মনে হয় । তিনি তেমন আহাম্মক নন বলেই সেই হাঘরে হাভাতে শিশুদের বরং চিনিয়ে দিতে চান


"কুড়চি ধুতরার মাদকতা মদির বিহ্বলতা"


মরমি কবি গভীর বিক্ষায় বুঝেছেন আপাত ভদ্র সভ্য পোশাক ধারিদের চেয়ে এই হাঘরে শিশুরা স্বভাবে মননে অনেক বেশি সুন্দর ।


তাই ডেকে ডেকে তাদের নিয়ে যেতে চান ধুলামলিন শিকড়ের কাছে,মাটির কাছে । যেখানে রবীন্দ্র সংগীত নয় বরং মেঠো ভাটিয়ালি সুর তাদের চিত্তকে করবে তরতাজা।তাই তেমন সংগীতের আস্বাদ কবি দিতে চান সেই সব শিশুদের। আর দিতে চান তাদের কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত জুঁই ফুলের মতো ধোঁয়া ওঠা সাদা একথালা ভাত ও একটু নুন। কেন কবি সাদা ভাত ও নুন দিতে চান ?কারণ কবির অমোঘ অনুভূতি--


"যেখানে আছে জীবনীশক্তি
সৌন্দর্যের রক্ত লেগে নেই।"


কি গভীর শ্লেষ প্রকাশ করে সমাপ্তি টানলেন কবি।এখানেই কবির কাব্যের সফলতা।আমরা যাদের সভ্য ভব্য বলি তাঁরা পরে থাকেন সৌন্দর্যের মুখোশ । কবি তাই সাধের সমাজ সংসারকে দিলেন গভীর খোঁচা।স্বাধীনতার এতো বছর পরেও যারা হাঘরে হাভাতের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেননা তাদের পোশাক বাইরের চোখে যতোই সুন্দর মনে হোক না কেন আসলে সেখানেই লেগে আছে ক্ষুধা নামক রক্তের স্পষ্ট দাগ ।


সুন্দর দার্শনিক বিক্ষণ এবং মানবিক আবেদন কবিতার পরতে পরতে ।যথার্থ নামকরণ।পাঠ করতে করতে মনে হলো আমরাও ফিরে যাই এই ইট কাঠের জঙ্গল ছেড়ে ধুলোমলিন শেকড়ের কাছে।যেখানে বসে শোনা যাবে কবির সান্নিধ্যে মধুর ভাটিয়ালি সুর ।


অসাধারণ কবিতা।প্রথম তিনটি লাইন এবং শেষ দুটি লাইনে কবি তাঁর মূল বক্তব্য মেলে ধরেছেন।মাঝের লাইনগুলো কবিতার আভরণ স্বরূপ কবিতাটিকে উৎকর্ষের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।সহজ সরল শব্দ কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনা কবিতাটির মূল চালিকাশক্তি।সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই ।