আমি এক জন্মান্ধ পথিক । কোথাও পৌঁছতে চাই । কিন্তু জানি না কোথায় ।  কবিতা লিখছি । কবিতার রহস্য আজও অধরা । এই বোধ সঞ্চারিত হওয়ায় একদিন লিখেছিলাম ঃ  
                  “ মজা পুকুর-ডোবা, গাছ-গাছালি, রুক্ষ মাঠ
                        পথ চলেছে এঁকে বেঁকে……
                     সে চলেছে নিজেকে
                                   রোদ্দুরে  এঁকে
                     পিছনে ছায়া...ঘন নীলছায়ান্ধকার
                     খানিকটা অনুমানে বুঝি ;
                                        সে কে !
                     সামনে থেকে দেখা হয়নি মুখশ্রী তার...
                     প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল তার সঞ্চরণ ভঙ্গিটুকু
                      পিছন থেকে দেখে দেখে …… “
  এখন নাকি কবিতার উত্তর আধুনিক যুগ ! এই যুগ-বিভাগটা আমার কাছে হাস্যকর । কবিতা অখণ্ডমণ্ডলাকার । তটরেখায় দাঁড়িয়ে ধারার সূচনা ও সমাপ্তি-বিন্দু খোঁজা, এক বিভ্রম-বিলাস । ভাষা কবিতার পোশাকমাত্র ।
   প্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষের পোশক-পরিচ্ছদে বিবর্তন ঘটেছে । শতাব্দীকাল আগে একজন নারী যে সাজ-সজ্জায় বিভূষিত হতেন আজ সেই সজ্জা-বিন্যাস আর দেখা যায় না।  পোশাকী রূপান্তর । নারী সেই আদি অকৃত্রিম নারী । প্রকৃতি চিরন্তন । প্রচ্ছদ বদলে বিষয়বস্তুর বদলে যাওয়া অসম্ভব  ।  
    ভাষা ও আঙ্গিক বদলেছে বলে চিরন্তন কাব্যের যুগ-বিভাগ কাম্য নয় ।
   “অসৌ মহেন্দ্রদ্বিপদান-গন্ধিস্ত্রিমার্গগা–বীচিবিমর্দ্দ-শীতঃ ।
   আকাশ-বায়ুর্দিনযৌবনোত্থানাচামতি স্বেদ-লবান মুখে তে ।।“ ২০
                                               (রঘুবংশম ১৩শ সর্গ )
  মহান কবি কালিদাসের এই কাব্য-ভাবনা ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা আজও আধুনিক । সহস্রাব্দের পারেও তিনি অপাঠ্য হয়ে যাননি ।
এ কথা ঠিক স্বতন্ত্র কাব্য-ভাষা নির্মাণ এক অতি দুরুহ ব্যাপার । অনেক প্রথিতযশা কবি সারাজীবন কাব্যানুশীলন করেও স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পারেননি । এক শতাব্দীকাল সময় সীমায় একজন দুজন সার্থকতা অর্জন করতে পেরেছেন । সম্প্রতি “আধুনিক কবিতা’ (?)ও “উত্তর আধুনিক কবিতায়” (?) “ফর্ম” নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে । কিন্তু ঈক্ষণ বড়ো সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট ।  ব্যাপ্তি নেই । কবিতা, কবিপ্রিয় গিনিপিগ হলে কাব্য-নন্দন কলা আক্ষরিক  অর্থে কপিপ্রিয় পক্ক স্বর্ণচম্পা কদলী যে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই ।
  যথেচ্ছভাবে শব্দ বিন্যাস করলেই যদি বিন্যস্ত শব্দগুচ্ছ কবিতা হয়ে ওঠে তাহলে “কবিপ্রাণী”টির যুগ যুগ ধরে স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হতনা । রাজা বা রাজন্যবর্গের সম্মানীয় পোষ্য হত না ।  
“ সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি।“  এমন আপ্তবাক্য পৃথিবীতে আর উচ্চারিত হয়নি ।
  প্রতি শব্দের একটি বৈচিত্র্যময় বর্ণবিভামণ্ডল থাকে, কবিতায় যখন শব্দ পাশাপাশি বসে তখন  সেই বর্ণবিভামণ্ডলের প্রসারণশীল বর্ণালী-বিভা-বৃত্ত পার্শ্ববর্তী বর্ণালী-বিভা-বৃত্তের সঙ্গে অন্তর্চ্ছেদ ঘটিয়ে এক সূক্ষ্ম, অনুভবে লালন-যোগ্য অতীন্দ্রিয় বাঙ্মময়তার জন্ম দেয় যা পাঠককে লোকায়ত থেকে লোকাতীত জগতের উতুঙ্গু শিখরে নিয়ে যায় ।
  আমি সেই শব্দযাদুকরের প্রতীক্ষায় আছি, আমার বন্ধুদের মধ্যে সেই যাদুকরের সন্ধান পেতে ইচ্ছুক । যদি পেয়ে যাই, তাহলে এই অন্ধ পথিকের বাইরের জগৎ আলোকিত না হোক, অন্তর-লোক এক দিব্য কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ।