কাল রাতে ঝুপ করে আলো চলে গেল । সারা পাড়া অন্ধকার । অগত্যা লেখা-লেখির অপ-প্রচেষ্টা ছেড়ে শুয়ে পড়লাম ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, না জেগেছিলাম তখন যেমন বুঝিনি, এখও মনে ধন্দ আছে । ঘুমটা ভেঙে গেল । ঘরে ছড়িয়ে আছে মায়াবী নীলাভ আলো । সেই আলোয় দেখলাম একজন উত্তরীয়তে  নাক চেপে দাঁড়িয়ে আছেন ।
বললেন, ভোঁস ভোঁস,
         কী করে ঘুমোস ?
মনে হল ঘুমোনোটা ওনার মতে দোষ ।
একজন অপরিচিত মানুষ আলাপ পরিচয়ের আগেই যদি অভিযোগ করে বসেন, রাগ না হলেও ক্ষোভ করার অধিকার মনে হয় আছে । আমার মনে অসন্তোষ ।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, চারদিকে মঁ মঁ করছে দুর্গন্ধ । নাকে লাগতেই বুঝলাম এ কাব্য-পচা গন্ধ ।
--কাব্য-পচা ?
--হুম তার সঙ্গে পচেছে অর্থালঙ্কার, শব্দালঙ্কার, ছন্দ । দুর্গন্ধে মাথাটা ঘুরে গেল । এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ।
দুর্গন্ধটা তোর ঘর থেকে আসছে, কৌতূহলে তাই নেমে এলাম ।
আমি তখন ভ্যাবলাকান্ত ।  বললাম, কোনও দুর্গন্ধ তো পাচ্ছি না । আপনই বা কে ? কিছু তো যাচ্ছে না বোঝা ?
উনি বললেন, আমি কৃত্তিবাস ওঝা ?  
--ও নামে তো কাউকে চিনি না । কোন কৃত্তিবাস ?
--হা হতোস্মি ! নিজের মুখে নিজের পরিচয় দিতে হচ্ছে  ।  আরে শ্রীরামের পাঁচালীকার, ফুলিয়া নিবাস ।
আমি তো অবাক ।
বললেন, অকবির কাব্য-রোগ, তাই দুর্বাচকযোগ ;
বুঝলাম যথার্থ অভিযোগ ।
বললাম, স্যার, আমার কী সৌভাগ্য । আপনাকে পেয়েছি বলেই খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এমন কী শ্লোক লিখেছিলেন যে গৌড়েশ্বর একেবারে ফিদা হয়ে গেলেন ?
--তুই যা বললি তার মধ্যে দুটো শব্দ যে আমি কৃত্তিবাস, সেই আমিও বুঝলাম না । ওই “স্যার” আর “ফিদা” ।
স্যার মানে কী ষণ্ড ? আর ফিদা কী “ফিদবি”র সংক্ষিপ্ত রূপ ?
ফিদবির মানে বুঝতে পারিনি আমি যথারীতি চুপ ।
উনি আবার বললেন, সম্মানীয় অতিথিকে ষণ্ড বলে ডাকা এখন বাংলার রীতি নাকি ?
আমি বললাম, না স্যার, ওই যাকে বলে ম্লেচ্ছ ভাষায়, স্যার মানে মহাশয় ।
--সেটা বললেই তো হয় ? আর ফিদা ?
--মুগ্ধ । আজকাল এটাই চলছে। বলতে বেশ সুবিধা ।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা কী যেন জানতে চাইছিলি ?
--রাজসভায় এমন কী শ্লোক পাঠালেন যে গৌড়েশ্বর একেবারে ফি... মানে কূপোকাত ? ওই শ্লোকগুলি তো আজও কেউ জানে না । যদি বলেন তো আমার আসরের বন্ধুদের শোনাই ।  
-- বলতে আমার ইচ্ছে কী হয় ?
  তোদের যা স্বভাব আমার কথা অপছন্দ হলে বা না বুঝতে পারলে জুড়ে দিবি আরো কথা । কৃত্তিবাসী রামায়ণ আমার কিনা আমারই সংশয় । বলছি লিখে নে । একটি শব্দও যেন না হয় এধার-ওধার ।
--না না কী যে বলেন স্যার ? মানে মহাশয় ।


উনি আমাকে যে সাতটি শ্লোক বলেছিলেন আমি ঠিক সেই শ্লোকগুলিই আসরের বন্ধুদের পাঠের জন্য প্রকাশ্যে নিয়ে এলাম ।

                                 সিদ্ধিদাতা নরপতি রাম-রাজ্য-কাল ।
                                 দনুজ-মর্দ্দন দেব পরম দয়াল ।। ১
                                 স্বয়ংসিদ্ধ জ্ঞানবৃদ্ধ ঋদ্ধ মহাশয় ।
                                 নরলোকে বরক্রতু প্রচ্ছন্ন নিশ্চয় ।। ২
                                 সিঙ্ঘেন্দ্রমধ্যম-রাগ রক্তিমা অপার ।
                                 চণ্ডী ধ্যান-জ্ঞান, চণ্ডীই সারাৎসার ।। ৩
                                 মহাবংশ পিতা হংস যবনের যম ।
                                 সুভগ গৌড়দেশ মহাসিন্ধু-সঙ্গম ।। ৪
                                 পুণ্যবান গৌড়েশ্বর ধন্য গৌড়জন
                                 দৃপ্ত তেজে অবলুপ্ত দানব গর্জ্জন ।। ৫
                                 কনক-কিরণ দিন দিনান্ত-বিহীন ।
                                 গৌড়ের শিখরে ধর্ম-কেতন উড্ডীন ।। ৬
                                 দেবানুগ্রহে দেহ বাগীশ্বরী আবাস ।
                                 মুখের  কথাই শ্লোক কহে কৃত্তিবাস ।। ৭