পরপর তিনদিন তিন ভাগে প্রকাশের পর আজ
পূর্ণ কাব্য কাহিনিটি দিলাম। অনেকে একবারে
পড়া পছন্দ করে বলে।
*********************---****
                  
আধুনিক লেখক পরিচয় খুঁজলে,
উপন্যাস বা কবিতায় মন ভরতে গেলে,
আজ যে নাম শীর্ষে সমাদৃত -
তা হলো , শ্রী মুক্তাক্ষর মিত্র।
শারদীয় পত্র পত্রিকার পাতা ওল্টালে,
কবি সম্মেলনে দৃষ্টি ঘোরানোয়,
বা দূরদর্শনের সাহিত্য সভায় -
অতি পরিচিত নাম 'মুক্তাক্ষর'।


আজ তিনি চলেছেন বোশেখী আসরে ,
সোনার তরীর ছাত্রদের আহ্বানে।
ছোট ছোট ছেলেগুলোর আমন্ত্রণ নিবেদন,
বাচনভঙ্গি - মুগ্ধ করেছিল ওকে,
তাই ওদের আন্তরিক টানে -
ও চলেছে 'সোনার তরী ' পানে ,
রবীন্দ্র জয়ন্তীর সান্ধ্য অনুষ্ঠানে।


সাদা ঝকঝকে এম্বাসডরের
রঙিন গদিতে হেলান দিয়ে তন্দ্রামগ্ন।
বিগত দশক জুড়ে অনেক পদক -
স্বাগত জানিয়েছে ওর সাহিত্য সম্ভারকে,
নাম যশ খ্যাতির শৃঙ্গে এখন মুক্তাক্ষর ,
পরিপূর্ণ কানায় কানায়।


তীব্র ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাবেশ কাটে ,
চারদিকে চিৎকার হৈ হট্টগোল -
ইতস্তত কথাবার্তায় বোঝা গেল ,
এক অল্পবয়েসী ছেলে গাড়ির তলায়
চাপা পড়ছিল, কপালজোড়ে বেঁচেছে !
নেশা করেছিল... রাবিশ।


পাঠকের মনমতো চাহিদা মেটাতে ,
পত্রিকার মর্জিমতো লেখা যোগান দিতে ,
যখন অশ্লীলতার দায় এড়িয়ে -
পাঠকের মনোরঞ্জনে লেখা নগ্ন হয়।
তখন আদর্শকে তালাচাবি দিতে,
রঙিন গ্লাসে ওকেও ডুবতে হয়।
ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ে, বাড়ে ষ্টাটাস্।
সেই সব লেখার মধ্যে হড়কানো ,
দু একটা মৌলিক সৃষ্টি -
যখন পদক এনে দেয় ,
পদকের মূল্য বোঝাতে -
তখন নেশার ফোয়ারা ছোটে ,
সাম্মানিক আনন্দ উৎসবে।
তা বলে এ রকম ! ছিঃ!
এরা যে কোথায় চলছে...কে জানে !


ঘুম আসছে না।
বৈপ্লবিক চিন্তাধারার স্রোত -
একসময় উৎস ছিলো ওর কবিতার।
মশাল পত্রিকায় প্রথম স্বীকৃতি।
যদিও মশাল আজ নীভন্ত প্রায় ,
তবু সেই জন্মদাতা ওর।
তখনকার স্বপ্ন সমাজ ছিলো এক টর্নেডো।
আজ ভাবলেও হাসি পায় -
লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা এখন,
ওর দরজায় পৌঁছােতেই পারে না।


কোথায় যেন উবে গেছে
টানটান উত্তেজনার সেই সব দিন।
পার্কে ঝালমুড়ির দিনগুলো -
চায়ের. চুমুকে সাহিত্য আলোচনা ,
দেশলাই সিগারেটে সুকান্ত।
সত্যজিত, ঋত্বিক বা মৃণালের
আনাগোনা যত্রতত্র।
সময় তখন ছুটতো রকেটের বেগে,
মাঝে মাঝে মনে হয় -
তখন আলোচনা বেশ গভীরেই ছিল।


কনফারেন্স. সেরে সবে ফিরেছে।
ডায়েরির পাতায় চোখ রেখে মনে পড়ে,
সোনার তরীর আমন্ত্রণে যেতে হবে -
প্রধান অতিথির আসন শোভনে।
যদিও দুমাস আগেই ঠিক ছিলো ,
তবু তেমন কিছু ভাবা হয়নি।


অবশ্য ভাবনার কী বা আছে?
শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিশাল জগৎ ,
মনের টানে না হলেও রেজাল্টের টানে -
এক সময় দখলেই ছিলো বিশ্বকবি।
এমন নিমন্ত্রণ না এলে সে সব ,
এখন আর কাজেও লাগে না।
এই সব ছুটকো ছাটকা অনুষ্ঠানে ,
ভরাট গলায় সামান্য জয়গানেই -
বাজিমাত।


লালবাতির নিষেধে স্তব্ধ প্রাইভেট।
শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়,
আচ্ছন্নতা কেটে যায় পথচারীর ডাকে ;
- আ...রে! .... মুক্তো না?
সাদামাটা পাজামা পাঞ্জাবি,
একমুখ দাঁড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ,
দেখতে দেখতে মোটা গ্লাসের চশমায় -
চোখ আটকায়।


- তু..ই...অবিনাশ তো?
অতীতের স্মৃতিতে ডুবতে ডুবতে,
হাত চলে যায় গাড়ির দরজায়।
- অায়, চট্ করে উঠে পর,
সিগন্যাল.. হয়ে .. গেছে..ওঠ্..
ইতস্ততঃ ভাব কাটিয়ে গাড়িতে অবিনাশ।


বন্ধুর ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত রেখে
মুক্তোর প্রশ্ন -
- তারপর! কি করছিস এখন?
- পাঠশালায় ছাত্র ঠেঙ্গানো,
   তবে বেশি দূরে নয়, বাদুতে।
- আরে আমিওতো ওদিকেই যাব
   রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ভাষণ দিতে।
- ওঃ। এখনো লেখাটা তবে ছাড়িস নি?
সম্মানে লাগে সাহিত্যিক মুক্তাক্ষরের
সত্যিই কি অবিনাশ -
ওর কোনো খবর রাখে না?
- কেন, তুই আমার লেখা পড়িস নি?
- ধ্যাৎ বাবা, গেঁয়ো স্কুল মাষ্টারের
  উপন্যাস, গল্প, কবিতা পড়ার সময় কই?
  স্কুল কোচিং মিটিং সারতেই দিনকাবার।  
- তবে ..এখন..যেন মনে পরছে..      
  তুই তো একাদেমিও পেয়েছিস, তাই না?
- সে তো অনেক বছর হলো।
  পারলে এখনকার লেখাগুলো পড়িস,
   ভালোই লাগবে মনে হয়।
- বাব্বা! বাবুর আমার আঁতে ঘা লাগলো?
  খারাপ লাগবে তো বলি নি,
  তবে হ্যাঁ, তুই তো জানিস -
  রবীন্দ্র জগৎ থেকে মুক্তি আমার নেই।
  তবুও দু চারটে যা পড়ি -
  অধিকাংশে মন ভরে না,
  সে হয়তো অক্ষমতাও হতে পারে।
  আসলে কি জানিস!
  আজকাল কচি কচি ছেলেমেয়ের মুখ,
  আমার সমস্ত মন জুড়ে থেকে যায়।
  ওদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর মুখভরা
  হাসির প্রেরণা যোগাতে দিন চলে যায়।
- বেশ আছিস তবে?
- তা বলতে পারিস্।
-  অসংখ্য ডানামেলা জীবনের ভীড়ে
   আমার জীবন কাটছে গতি নিয়েই।


টুকটাক আলাপে সংলাপে জানা গেল -
অবিবাহিত অবিনাশ আজও খুঁজে চলেছে
রবীন্দ্র ভাবনা পুষ্ট. শান্তির অাশ্রয়।
দশবারো দিন বাদে এখন ফিরছে ;
বোলপুর থেকে, সেমিনার ছিলো।
মাঝেমাঝেই ওকে ছুটে যেতে হয় -
ছাত্রাবাসের উন্নয়নের জন্য।
তাই, অবিনাশ জানেও না,
মুক্তো চলেছে ওরই হাতে গড়া ছাত্রাবাস -
অবৈতনিক শিক্ষায়তন সোনার তরীতে।
শুনে বিস্মিত হয়েছে,
আনন্দও পেয়েছে অনেক।
- জানিস, এবার ওঁর জন্মদিনে আর
  শান্তিনিকেতনে থাকাও গেল না।
বেশ বুঝতে পারছিল মুক্তো -
লালমাটীর টান মনের অনেক গভীরে।
অবশ্য এটাই স্বভাবিক।


বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে গিয়ে -
রেকর্ড গড়ার দৃষ্টান্ত ওই রেখেছিল,
কি অসম্ভব জ্ঞান আর অনুভূতি ছিলো!
অথচ ভীষণ আপনভোলা ছেলে।
বিশ্বকবির প্রতি ওর শ্রদ্ধা -
স্মরণ করাতো আমাদের যেন,
ধ্যানমগ্ন এক সাগ্নিক পুরুষোত্তমকে।


বহূদিন পরে -
আজ সোনার তরীর রবীন্দ্র শ্রদ্ধাবাসরে,
ওরা পাশাপাশি একই আসরে।
এ পর্যন্ত ছাত্রাবাসের আন্তরিকতা,
আর অকৃত্রিম ভালবাসা,
মুগ্ধ করেছে মুক্তাক্ষরকে।


একটু আগে শেষ হয়েছে -
অবিনাশের ছোট্ট ভাষণ,
প্রতিটা বাক্যে কি আশ্চর্য সংযম!
কি অসাধারণ উপলব্ধি -
বিশ্বকবির সৃষ্টি ও কল্পনার সামঞ্জস্য প্রতি ।
এখনও কানে ভাসছে ;
'গতিশীল জলদের ঊর্ধ্বে গমন -
যেমন শেষ আশ্রয় খোঁজে হিমাদ্রি শিখরে,
আমাদের আশ্রয়ও তেমনই ,
উন্নত শিরে রবির কিরণ আলিঙ্গন। '


রোমাঞ্চিত মুক্তাক্ষর!
অনুভব করছিল প্রতি পলে পলে,
সৃষ্টি সন্ধানে রবীন্দ্র ভাবনা।
তাঁর চিন্তাধারা ছিলো কত দীপ্তিময়,
এ ভাবনা হয়তো -
ওর উপলব্ধিতে আসতোই না কখনো ,
সোনার তরীর আহ্বানে এখানে না এলে।


এবার বক্তা মুক্তাক্ষর।
ভাষন এক সময় ভালোই দিত সে,
এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলো না কিছুই,
অজস্র করতালিতে হারাতে..হারাতে..
মুক্তোর ভাষণ শেষ হলো।


আর কেউ না জানলেও -
মুক্তো কিন্তু জানে,
ওর গম্ভীর গলায় ভাষন ছিলো -
উত্তাল সাগরের দুরন্ত লহর,
তীরে বসা শ্রোতার মনে তরঙ্গ তুলেছে।


কিন্তু অবিনাশ!
নিজেই ডুবে ছিলো সাগর অতলে,
নিস্তরঙ্গ মনি মুক্তার গোপণ সন্ধানে।
অবিনাশ যা বলেছে -
সবই তার চেতনার রঙতে রঙিন।


মুক্তা আজ সব কিছুই  ধার করে গেছে
বিশ্বকবির অতুল সম্ভারেতে ডুবে।


তবু আজ এতকাল বাদে -
তৃপ্তি খুঁজে পেল মুক্তা,
রবীন্দ্র সাগরে ঝাঁপ দিয়ে।
মুক্তার বাসনা দল নবরূপে
প্রস্ফুটিত হলো,
এই পঁচিশে বৈশাখে।


নতুন ভাবনায় -
কলম তার ঘোরাতেই হবে,
জীবনের প্রতিটা ক্ষণ,
কি ভীষণ ভাবে বন্দী হয়ে আছে -
বিশ্বকবি মাঝে,
বুঝলো তার অন্তরাত্মা থেকে।
সোনার তরীর সাদর আহ্বানে ,
বিশ্বকবি অনুসৃত এক প্রেমিকের -
হৃদয় ঢালা শ্রদ্ধা  নিবেদনে।


                  সমাপ্ত