প্রথমেই বলে রাখি যারা অভিজ্ঞ অথবা যারা গদ্যছন্দ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী নন, তারা এই লেখাটি এড়িয়ে যেতে পারেন।

ফ্রি-ভার্স / গদ্যছন্দ / মুক্তছন্দ যাই বলুন এটা মূলত অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই একটি রূপমাত্র।

গদ্যছন্দ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ গদ্যে যেমন বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তেমনি 'লিপিকা', 'পুনশ্চ', 'পত্রপুট', ' আরোগ্য'- এর প্রচুর কবিতায় এ ছন্দনিরীক্ষার পরিচয় রেখেছেন। তার দুটি মন্তব্য স্মর্তব্য :
১. গদ্য কাব্যে অতি নিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙ্গাই যথেষ্ট নয়, পদ্ম কাব্যে ভাষায় ও প্রকাশ রীতিতে যে একটা সসজ্জ, সলজ্জ অবগুকণ্ঠন প্রথা আছে তাও দূর করলে তবে গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে।
২. গদ্যই হোক আর পদ্যই হোক রসরচনামাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত। সেই নিগূঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয়। পদ্যছন্দ বোধের চর্চা বাঁধা- নিয়মের পথে চলতে পারে , কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণবোধ মনের মধ্যে যদি সহজ না থাকে অলংকারশাস্ত্রের সাহায্যে এর দুর্গমতা পার হওয়া যায় না অথচ অনেকেই মনে রাখেন না যে, যেহেতু গদ্য সহজ, সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়।

কবিগুরুর কথায় কি বুঝলেন?
অক্ষরবৃত্ত/ মাত্রাবৃত্ত /স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখা সহজ হলেও গদ্যছন্দ মোটেই সহজ বিষয় নয়।

গদ্যছন্দ লিখতে হলে অবশ্যই ছন্দকে ভেতর থেকে উপলব্ধি করতে হবে। আপনি ছন্দকে পূর্ণ আয়ত্তে আনতে পারলেই গদ্যছন্দ লিখতে সক্ষম হবেন।

মনে রাখতে হবে কোন কাজই ছন্দহীন নয়। ছন্দ মূলত অদৃশ্যমান একটি জিনিস যা প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্নিহিত একটি Power বা শক্তি,দ্যোতনা। প্রত্যেক মানুষের জীবনেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। ছন্দ মূলত একটি পরিমিতি বোধ বা পরিমিতি জ্ঞান, একটা শৃঙ্খলা, একটা স্রোতধারা যা আমাদেরকে গন্তব্যের শেষ প্রান্তে অবলীলায় পৌঁছে দেয়। একজন বাস চালকের কথা ভাবুন- ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত যেতে তার বাসকে কতোভাবে কতো বুদ্ধিমত্তার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেন। ঐ নিয়ন্ত্রণ কৌশলটাই তার ছন্দ।
গদ্য কবিতার ভেতরেও অনুরূপ ছন্দ থাকবে, যা অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতার মতো অনেকের কাছেই (যাদের ছন্দ জ্ঞান নেই) ছন্দটা দৃশ্যমান হবে না, ছন্দকে তারা আবিষ্কার করতে পারবেন না। তাদের এই অক্ষমতাই তাদেরকে ভ্রান্ত পথে  ধাবিত করছে।
প্রকৃত পক্ষে ছন্দ ছাড়া কবিতার অস্তিত্ব নেই, থাকবে না। যারা বলেন: গদ্য কবিতার ছন্দ নেই, তারা মারাত্মক ভুলই বলেন। গদ্যছন্দ মানে ছন্দহীনতা নয়। ছন্দ অবশ্যই থাকবে। সেটা ধরার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আমাদের। আমাদের অনেক অগ্রজের মানসম্পন্ন কালোর্তীর্ণ গদ্যকবিতা (ছন্দোবদ্ধ) রয়েছে, যা সাধারণ পাঠকের কাছে, নবীন অকবির কাছে ছন্দহীন মনে হতে পারে।

গদ্য কবিতায় মূলত মুক্তছন্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।আর মুক্তছন্দটা নির্ভর করে- অক্ষরবৃত্তের পরিবর্তিত রূপের ওপরই। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কাঠামোতেই গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দের বিস্তার বা প্রসার। যখন অন্ত্যমিলীয় রীতিতে অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার করা হয় তখন প্রতি চরণে নির্দিষ্ট মাত্রা বসানো হয়। যার শুরুটা হয় সাধারণত ১৪ মাত্রা দিয়ে (৮+৬) । এছাড়া ১৮ মাত্রা (১০+৮), ২২ মাত্রা (১২+১০) এই মাত্রাকেন্দ্রিক পর্ব বিভাজনও একবোর আবশ্যকীয় নয়। তবে সঙ্গতিটা ধরে রাখতে পারলে চমৎকারীত্ব আসে, ভিন্ন আবেগ বা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়, কবির সৃজনশীলতা দীপ্ত হয়।
এর বাইরে চরণের মোট মাত্রা ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ করেও সাজানো যায়। কখনো কখনো আধুনিক কবিগণ এক চরণে ০৮ মাত্রা দিয়ে পরের চরণে ১০ মাত্রা দিয়ে মাত্রার কাঠামো ০৮+১০=১৮ ঠিক রাখেন। আবার প্রথমে ১২+পরে১০মাত্রা দিয়ে ২২মাত্রার হিসেব করেন। কখনো ১৬+১০/ ১৮+১২=৩০/ ২০+১৪=৩৪ দিয়ে মাত্রার হিসেব ঠিক রাখেন।
গদ্য কবিতায় মুক্তছন্দের নামে মূলত এই জাতীয় হিসেবকে বিবেচনা করা হয়। যেখানে মুক্তাক্ষর এক মাত্রা বিশিষ্টি হয় এবং বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে ব্যবহৃত হলে দুই মাত্রা বিশিষ্ট হয় (তিন জায়গায় ব্যতিক্রম হয়ে থাকে: কথ্য ক্রিয়াপদ, নির্দেশক পদ এবং সমাসবদ্ধ পদ, যেখানেই বদ্ধাক্ষর বসুক দুই মাত্রা হিসেব ধরা হবে।)।
মুক্তছন্দ সাধারণত স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের বাঁধনে বাঁধা যায় না। কারণ স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের পর্ব মাত্রার চালটা একবারেই নিয়ন্ত্রিত, অংকের মতো, বিজ্ঞানের সূত্রের মতো। অক্ষরবৃত্তের উদার নীতিই তাকে গদ্য ছন্দের বাহন করেছে। আমরা জানি: সমপর্ব ও সমমাত্রার বাধ্যবাধ্যকতা নেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। যার কারণে কবি এখানে মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। তিনি কবিতার চরণকে ছোট বড় করবেন একটি ছকের মধ্যে ফেলে, ফ্রেমের মধ্যে রেখে। আর সেটা হলো: ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ মাত্রা বিশিষ্ট চরণ। এর বাইরেও যে মাত্রা গণনার আরেকটি কৌশল ব্যবহৃত হয়ে থাকে তারও উল্লেখ করা হয়েছে (ভিন্ন ভিন্ন চরণে: ৮+১০/ ১০+৮/ ১২+১০/১০+১২/ ১৪+৮/৮+১৪/ ১০+২০/২০+১০/ ১৬+১০/১০+১৬ প্রভৃতি)।

গদ্যছন্দ কিছু বৈশিষ্ট্য:
• গদ্য ছন্দ এক ধরনের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ তাই এর মাত্রা গননা করা হয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নিয়মে এবং চরণগুলো জোড়া মাত্রার হয়ে থাকে (তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে)।
• গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রঙ ধরানো হয়, তখন গদ্যকবিতার জন্ম হয় ।
• পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়, সাধারণত পর্ব-দৈর্ঘ্যে কোন ধরনের সমতা বা মিল থাকে না।
• পদ ও চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়; এই বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন উচ্চারণের সুবিধার্থে নয়, বরং অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়।
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরনের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়।
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও এর পদবিন্যাস কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ও পুনর্বিন্যাসিত হতে হয়।


গদ্যছন্দে রচিত (বিবর্তিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ) দু-একটি গদ্য কবিতাকে সামনে আনলে আশাকরি গদ্য কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ বা প্রয়োজনটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য

যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ রাত্রে-12
তার মুখে খবর পেলুমঃ-10
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,-10
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার-18
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।-10
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত-18
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।-18
সে ভাষা বুঝে না কেউ,কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।-22
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা-14
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-14
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ট শিশুর-14
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।-10
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;-18
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে-18
চলে যেতে হবে আমাদের।-10
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ-18
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল-14
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-18
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।-18
অবশেষে সব কাজ সেরে,-10
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে-14
করে যাব আশীর্বাদ,তারপর হব ইতিহাস।।18

কবির এই ছাড়পত্র কবিতার মধ্যে চার ধরণের চরণ পেয়েছি। 10 মাত্রার চরণ,14 মাত্রার চরণ,18 মাত্রার চরণ এবং 22 মাত্রার চরণ। কী চমৎকার মুক্তছন্দের প্রয়োগ করেছেন কবি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মুক্তক মাত্রা ব্যবহারের কথায় আমরা আগেই এমন বিন্যাসের কথা উল্লেখ করেছি। এই 6,10,14,18,22,26,30,34,38 মাত্রার চলনই মুক্ত অক্ষরবৃত্তের চাল।

কবি জীবনানন্দ দাসের ‘আকাশনীলা’ গদ্য কবিতাটি মাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি:

আকাশনীলা –
(জীবনানন্দ দাশ)

সুরঞ্জনা,ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-14
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা; 08
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;-14
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;-10
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;-10
দূর থেকে দূরে – 06
আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।-18
আকাশের আড়ালে আকাশে-10
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ;-10
তার প্রেম ঘাস হয়ে সুরঞ্জনা,14
ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-10
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;08 
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে; 14

কবি জীবনানন্দ দাসের এই কবিতাতে আমরা 6,10,14,18 মাত্রার চরণ পেয়েছি। শেষের দিকে ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা’ চরণটিতে কেবল 08 মাত্রা পেয়েছি কিন্তু পরের চরণের 14 মাত্রার সাথে যার হিসেব যুক্ত করলে মোট মাত্রা 22 দাঁড়াবে। এরদ্বারা আবারো প্রমাণ হলো-গদ্যকবিতা ছন্দহীন নয়, বরং ছন্দবদ্ধ।

কবি শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটির মাত্রা দেখে নিতে পারি:

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।-26
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়-22
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে-22
শিউলিশৈশবে 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন-22
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,-26
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,-14 
(অংশ বিশেষ)

কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মুক্তছন্দের মাত্রা বিন্যাস আমরা লক্ষ্য করি-14,22,26 মাত্রা সম্বলিত চরণ। এসব কবিতা কী তবে ছন্দহীন, নাকী ছন্দবদ্ধ?

এপার বাংলা ওপার বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিপ্রাণ কবি আল মাহমুদ ছন্দের দোলা ছাড়া কবিতা হয় না বলেই দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করেছেন। ছন্দের মায়াজালে আবর্তিত হবে কবিতা।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও বাংলা কবিতার ছন্দ- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

লেখার মধ্যে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ কবি!