খোকন এলো না কেন রে
আমি যে পথ চেয়ে বসে আছি,
তারে ছাড়া আমি কেমনে-
কি নিয়ে বাঁচি।


দেখ না পেঁপেটা পেকে গেল নাকি,
আস্তে ধর পোড়ামুখী
অত জোরে ধরলে পঁচে যাবে বৈকি।
পাকা পেঁপে খোকন আমার আহা!
কত আয়েশ করে খায়,
দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।


আচ্ছা, খোকন কী খুব বেশি পড়ে?
- পড়বেই তো, নইলে কি আর অত দেরি করে
সব পড়া শেষ করে তবেই না তার ছুটি;
আচ্ছা, ও কী সারারাত জেগে পড়ে?
- আহা! বাছা না জানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে
ঠিকমত খায় কিনা কে জানে?
আচ্ছা, ও তো রাতে এক গ্লাস দুধ খেত
এখনো কী খায়?  নাহ, অত টাকা কোথা পাবে?


দেখতো গরুটা ঘাস খাচ্ছে কিনা,
খোকন এলে ঠিকমত দুধ দিবে তো
আহারে! বাছা না জানি কত দিন দুধ খায় না।
আচ্ছা, খোকন কী ওখানে মাছ খায়?
কই, মাগুর, শিং, পুঁটি, মলা, ঢেলা, বাইলা
এসব কি ওখানে পাওয়া যায়?
নাহ্, সব কিছুর যা দাম!
এত টাকা খোকন পাবে কোথায়।


দেখ তো জালটা ঠিক আছে কিনা?
ফুটোগুলো দেখে দেখে রিফু করে নে
খোকন এলে মাছ ধরতে হবে না।
কোথা গেলি, নারকেলগুলো কেটেকুটে নে
ও, তুই তো আবার কালোপিঠ ফরসা করতে পারিস নে,
দে দে আমাকেই দে, তুই বরং পানিটা ফুটিয়ে নে।
নারকেলের চিঁড়া খোকন আমার কত ভালোবাসে
এতগুলো দেখে কত খুশি হবে
দেখতে পাচ্ছি তা চোখের সামনে অনায়াসে।


শুনেছিস, ওখানে নাকি তিন রবিবারেই মুরগী খাওয়া যায়!
ছিঃ ছিঃ মাসও হলো না, এ আবার খায় কেমনে
লোট আর পিছলা একাকার হয়ে যায়।
বড় মুরগীটা কোথা গেলো দেখ তো
দে দে চাল তারে বেশি করে দে
খোকন এলে তবেই না শান্তি
এখন এলে খোকন কতো মজা হতো।
পোলাও আর মুরগীর জাল মাংস সাথে শসার সালাদ
ওহ্, কি মজা করে খোকন খায়,
দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।


আচ্ছা, ওখানে নাকি চিকন চালের ভাত খায়!
কি যে করে না ছেলেটা!
চিকন চালের ভাতে কী পেট ভরে
মোটা চালের ভাত খেয়ে কত আরাম পাওয়া যায়।
মটকীটা কই গেল- ওই তো গোলার ধারে
নে নে চালগুলো তুলে রাখ
বাপ আমার এবার এলে 'পরে
যেতে পারবো না কারো দ্বারে দ্বারে।


জানিস, ওখানে নাকি ডিমটা ও কিনে খেতে হয়!
আহারে! ডিমটা ও যদি না খায়
বাছা আমার কেমনে বেঁচে রয়,
কত কত ডিম আমার ঘরে পঁচে যায়
আর মনে হয় বাছা আমার না খেয়ে রয়।


শোন, তুই কিন্তু নিজ হাতে এবার শিমের মাচা বাঁধবি,
আর আমি দু'বেলা করে পানি দেব
পাখি কিন্তু তুই-ই তাড়াবি।


লাউয়ের মাচাটা আরো মেলে দিতে হবে,
- কচি লাউয়ের পাতা আর হালকা চিকন আলু
হালকা ভাঁপে সে কি মজা!
খোকা না ডাঁটাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে।


বেলা গড়িয়ে যায়, সন্ধ্যে হয়
তবুও কী মায়ের কল্পনার শেষ হয়।
ছোট বোনটা মায়ের বকুনি খায়
তবুও মুখ বুজে সয়ে যায়।
সে জানে, মা তাঁর ছেলের আসার প্রতীক্ষায় অধীর
কিন্তু একদিন মায়ের বুকটা ভেঙ্গে হল চৌচির।


দিন গেল, মাস গেল, বছর ঘুরে এলো
তবু ও মায়ের খোকন ফিরে না এলো।
উদাসিনী পল্লী জননীর বুকফাটা আর্তনাদ-
আমার খোকন কই গেল?


ট্যাংক এলো, মর্টার এলো, সাথে সাথে বোমা ফাটল
বিমান এলো, কামান এলো, ঢাকা শহর পোড়ানো হলো
বাড়ি গেল, গাড়ি গেল, সাথে গেল ছাত্রদের হল
শ্রমিক গেল, মজুর গেল, সাথে মায়ের খোকন ও গেল
ডাক্তার গেল,শিক্ষক গেল, মা-বোনদের ইজ্জতও গেল।


লাঠি নিল, বৈঠা নিল, আরো নিল রাইফেল
কিষাণ এলো, মজুর এলো, মা-বানেরা ও যোগ দিল
রক্ত বইল, ইজ্জত দিল, মরল এবং মারল
তবুও সবাই স্বাধীনতা ঘরে নিয়ে ফিরল।


বড় রাস্তার মোড়ে এখনো দেখা যায়,
হতভাগিনী সেই পল্লী জননীকে উদাস চেহারায়
কি যেন ভাবে আর এদিক ওদিক তাকায়;
আকাশের দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত চায়-
আমার খোকন কোথায়?


রুবু মুন্নাফ
০১-০১-২০১০
দক্ষিণ রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।