বিয়োগ ব্যথা
(ঢাবি'র ছাত্র আবু বকর স্মরণে)


রাজপথে ঐ মিছিল নেমেছে
দাবী আদায়ের লক্ষ্যে,
সবাই নেমেছে ওই মিছিলে
আমরা কাদের পক্ষে?


মিছিল হল, মিটিং হল, হলো তদন্ত
তদন্তের কি শেষ হবে আর চলবে অনন্ত,
ভিসি এল, প্রক্টর এল, এল মহন্ত
তারপরও কি আবু বকরকে পাব জীবন্ত?


হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে কার লাশ?
পুলিশ কেন ঘিরে রেখেছে তার চারপাশ?
বন্ধুদের চোখ আজ কেন অশ্রুসজল;
অসহায় ভায়ের হাহাকার আর
অবারিত শ্রাবণের ঢল।


শোন একটি মায়ের গল্প বলি-
ভাই আর বোন তিনে তিনে ছয়,
আবু বকরকে তবুও আলাদা করতে হয়।
মায়ের চোখে যদিও সবাই সমান
তবুও কারো প্রতি থাকে আলাদা একটু টান।


পল্লী জননীর থাকবে তেল ছপছপে চুল
আর পান খাওয়া রঙিণ ঠোঁট
মুখে এক টুকরো হাসির ঝিলিক-
এইতো সুখী জননীর প্রতিচ্ছবি,
কিন্তু জননী মাথায় তেল দেয় নি তিন বছর!
পান মুখে দিয়েছে কবে মনে নেই।
চোখে যদিও ছিল সামান্য হাসির ঝিলিক
ছেলের গর্বে মনে ছিল আনন্দের কূলধ্বণি
আর সার্থক গর্ভধারিনীর।


অনটনের ছায়ায় ছেলেকে
গ্রাস করে দিতে চায় নি জননী,
স্বামী, সন্তান আর নিজেকে বঞ্চিত করেছে
তারপরও দ্বিধা ধরণী।


দিনমজুর আর ময়রা ছেলের রোজগার
এই নিয়ে জননীর চলে না সংসার।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের খরচ কিভাবে চালায়-
তাই তো জননী, মাথায় তেল দেয় না,
মুখে পানের খিলি দেয় না,
শুধু খরচ বাঁচায়।


ঘরের মুরগী ডিম দেয় আর জননী জমা করে
নিজেকে না, স্বামীকে না, এমনকি অন্য সন্তানদের
জননী ডিম খেতে দেয় না।
শুধু জমা করে আর ছেলেকে টাকা পাঠায়।
এমনি করে দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে যায়
তবুও জননীর দুঃখ না ফুরায়।


একদিন হাসি মুখে ছেলেকে শুধায়-
'বাপধন তোর পড়া কি শ্যাষ হবি না?'
ছেলে মায়েরে বুঝায়-
'আর একটা বছর কষ্ট কর না,
আমি পাস করে বের হলে ভাল চাকরি নেব
তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না'।


ছেলে টিউশনি করে না
কোথাও বের হয় না,
যদি প্রথম হতে না পারে
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে না।


গোবরে পদ্ম ফুলের কুঁড়ি দেখা গেল
কিন্তু একি এ যে অসময়ে ঝরে পড়ল।
একটি একটি করে পাপড়ি মেলার সময় যখন হল
অকালেই কেন তাকে ঝরে পড়তে হল?


ওখানে কার চিৎকার শোনা যায়-
'আমার বাবা কনে চইলা গেল,
আমার বাবারে আইনা দেও'
- এরপর বারেবারে চেতনা হারায়।


আরেক ছেলে ফারুকের কান্না বাঁধ না মানায়-
' আমার ভাই কোন দল করত না,
মারামারি করতেও যায় নাই।
তারপরও কেন তাককে মরতে হলো'?
এ প্রশ্নের উত্তর কোথায়?


ভাঙ্গাচোরা বাঁশের বেড়ার দুটি ঘর
তারপাশেই খোঁড়া হচ্ছে
আবু বকরের কবর।


বৃদ্ধ পিতার বুকফাটা আর্তনাদ আর হাহাকার
এই কি তবে পেল সারা জীবনের কষ্টের পুরষ্কার।
জোয়ান ছেলের লাশ কাঁধে তুলে দাঁড়ায়
সঙ্গে সঙ্গে হায়! জনক চেতনা হারায়।
পিতা বেঁচে থাকতে পুত্রের লাশ কাঁধে নিতে হয়
এর চেয়ে কষ্টের কিছু কি পৃথিবীতে হয়?


অকালে ঝরে গেল একটি তাজা প্রাণ
সাথে নিয়ে গেল কষ্ট পাহাড় সমান।


হতভাগিনী সেই পল্লী জননীর তাসেরঘর
নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার,
এবং একটি সংসারে শুরু হল
দুঃখ বেসুমার।


আবু বকরেরা কেন অকালে ঝরে যায়
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে চাওয়া কি
তাদের অন্যায়?
একজনের লালশার আগুনে কেন
অন্যকে পুড়তে হয়,
ঘামেভরা জীবন কেন রক্তে ভিজে শেষ হয়?


রুবু মুন্নাফ
০৪-০২-২০১০
নবাব কাটারা, ঢাকা।