চর্যাপদের অধিকাশ কবিতা-ই দশ চরণে সমাপ্ত। তারপর মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, প্রণয়োপাখ্যানসহ আরও কিছু ঘরানার (genre) কাব্য শুধু সুদীর্ঘ-ই নয়, কখনও কখনও ক্লান্তিকরও বটে। আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুকরণে এবং প্রভাবে কাব্যের বাঁক বদলে যেতে শুরু করে। মহাকাব্য লেখার হিড়িক কাটিয়ে  প্রবেশ করলো গীতিকবিতায় অর্থাৎ ব্যক্তিগত দুঃখ, খেদ, নির্বেদ, কষ্ট, বিরহ মোড়ানো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবিতায়। কবিতার ইতিহাস বর্ণনা আলোচনার উদ্দেশ্য নয়।


বাংলা সাহিত্যে অণুকবিতার জনক বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যিনি কিছু কবিতাকে দীর্ঘ ভাবনা থেকে অণুভাবনায় রূপান্তরিত করেছেন। মূলত কণিকা কাব্যে এরকম অনেক কবিতার দেখা মেলে। দৃষ্টান্ত :


উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।।


রবীন্দ্রনাথের পর আমরা বিভিন্ন দশকে অনেক কবিদের দেখতে পাই যাঁরা কবিতার প্রকরণে, বিষয়ের বৈভবে ও প্রাতিস্বিকতায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ষাটের দশকের পর থেকে এক ধরনের কবিতা লক্ষ করা যায় যেগুলোকে গুচ্ছ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পরে অনেকেই গুচ্ছ কবিতা লিখেছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটি গুচ্ছ কবিতা :


দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা
বুঝতে কেন পাছো না ছাই
মানুষ আমি, যন্ত্র না!


তবে স্বাধীনতার পূর্বাপর অণুকবিতাও চলতে থাকে। আবুল হাসানের কবিতা থেকে একটি দৃষ্টান্ত :


ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!


কিংবা হেলাল হাফিজ থেকে :


নিউটন বোমা বোঝো,
মানুষ বোঝো না।


পাশাপাশি এও বলে রাখা ভালো যে ইংরেজি সাহিত্যের কাপলেট এবং কোয়াটরেন (ইংরেজি উচ্চারণ ভিন্ন, এখানে বাংলা ভাষায় আদলে লেখা হলো), জাপানি সাহিত্যের হাইকু, ফারসি সাহিত্যের রুবাই এবং উর্দু গজল বা শের দ্বারা অনেকেই সরাসরি বা প্রছন্নভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা লিখেছেন; কেউ কেউ এখনও লিখে যাচ্ছেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে দ্বিপদী, ত্রিপদী (এগুলো মূলত অর্ধযতিবিশিষ্ট ছন্দবিভাগ) লক্ষ করা যায় তবে এগুলো দীর্ঘ কবিতার অংশ হিসেবেই। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকের কল্যাণে এক ঘরানার কবিতা লক্ষ করা যায়। এ সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস আকারে অনেকেই তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে থাকেন যেখানে কষ্ট, বিষাদ, বিরহ এগুলো-ই মূলত প্রকট আকারে দেখা যায়। এরকম কবিতাগুলোকেই আমি 'স্ট্যাটাস কবিতা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। এ ধারার অন্যতম জনপ্রিয় কবি হলেন সাদাত হোসাইন। এরকম কয়েকটি স্ট্যাটাস কবিতার নমুনা দেয়া যেতে পারে।


আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর...
(সাদাত হোসাইনের 'আমি একদিন নিখোঁজ হবো' কাব্যগ্রন্থ থেকে)


কিংবা ইমতিয়াজ মাহমুদ এর 'কালো কৌতুক' কাব্যগ্রন্থ থেকে :


জলের উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকা বক
তোমায় দেখে বাড়ে আমার নদী হবার শখ।


কিংবা হেলাল হাফিজের 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' থেকে :


তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।


কিংবা আমার নিজস্ব একটি পছন্দের স্ট্যাটাস কবিতা হতে :


কতটুকু নিখোঁজ হলে তুমি নেবে আমার খোঁজ
ধ্বনিগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে রোজ।