তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ।
- রুনা লায়লা।


পাশের বাড়ির ঐ ছেলেটা হেসে কথা কয়
আমায় দেখে অপলকে অবাক চেয়ে রয়
চলার পথে দেখা হলেই ফিরে ফিরে চায়
কিছু বলার আগেই হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।


এমন করে বছর পাঁচেক কেটে গেল দিন
বেলা গেল সন্ধ্যা হলো বাজল প্রেমের বীণ।
কলেজ শেষে ভার্সিটিতে যখন আমি পড়ি
রঙিন খামে এনে দিলো সুন্দর একটা ঘড়ি।  


বলল হেসে,যাচ্ছি আমি আনতে স্বাধীনতা
লাল সবুজের বিজয় এনে দেবো পাকা কথা।
যুদ্ধ হলো বিজয় এলো স্বাধীন হলো দেশ
রক্ত দিয়ে লেখা হলো সোনার বাংলাদেশ।


তার আশাতে আজও আমি স্বপ্ন এঁকে যাই
আকাশ পাতাল খুঁজে মরি কোথায় তারে পাই?
কথা দিয়ে রাখলো না সে আসলো না আর ফিরে
মনের ভিতর যতো স্বপ্ন ছিলো তারেই ঘিরে।      


বিজয় নিশান যখন উড়ে আকাশের ঐ পানে
গর্বে তখন মনটা ভরে পুলক আসে প্রাণে    
সোনার বাংলা গান গেয়ে যাই রাখাল বাজায় বাঁশি,
তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ তোমায় ভালো বাসি।


(কবিতাঃ তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ।
    কবিঃ রুনা লায়লা।


আলোচনাঃ


যুবক যুবতীর প্রেম ভালোবাসা যৌবনের এক স্বাভাবিক ধর্ম। অন্যদিকে যৌবনে যখন ব্যক্তিগত প্রেমের পাশে দেশপ্রেম ও মনে স্থান পায়,তখন সে প্রেমে এক স্বর্গীয় সুরভী পাওয়া যায়। সেই বিবেচনায় "তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ" দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমের এক সুগন্ধি কবিতা।


কবিঃ রুনা লায়লা। স্বাধীনতা উত্তরপ্রজন্মের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ চাক্ষুস করেননি তিনি। তথাপি কবিত্ব আর কল্পনা শক্তির বলে তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন সেই সময়কে। আলোচ্য কবিতায় পাশাপাশি বাড়ির দুই প্রতিবেশী যুবক যুবতীর প্রেম ভালোবাসা'র ইতিবৃত্ত সরল সাদামাটা ঢংয়ে উপস্থাপন করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভুমিকায় ব্যক্তিক প্রেম আর দেশপ্রেমের এক তুলনামূলক চিত্র এঁকেছেন তিনি,প্রাঞ্জল ভাষা আর ছন্দোবদ্ধ বাক্য বিন্যাসে। যেখানে ব্যক্তিগত প্রেমের টান দেশপ্রেমিকের দেশাত্মবোধে কোন অন্তরায় হতে পারেনি।


যুবক তাঁর প্রেয়সীকে একটি সময় নির্ণায়ক ঘড়ি উপহার দিতে এসে জানায় আমি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাচ্ছি , তুমি অপেক্ষায় থাকো, যুদ্ধ শেষে বাড়ি এসে আমাদের বিয়ের পাকা কথা বলবো। যদিও যেকোন যুদ্ধশেষে যোদ্ধার নিরাপদে গৃহ প্রত্যাবর্তনের কোন গ্যারান্টি থাকেনা। অথচ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার মনে একথা ভুলেও উদয় হয়না যে এটাই তাঁর শেষ যাওয়া। আর তাঁর প্রেয়সীর চিরদিনের প্রতীক্ষা আর পথ চাওয়ার শুরু। প্রেয়সী ও প্রিয়তমকে বাধা দিতে পারেনি যুদ্ধে যেতে। সেও ঐ দেশপ্রেমের কাছে আত্মসমর্পণের কারনেই।


অতঃপর যুদ্ধ শেষ হলো দেশ ও স্বাধীন হলো, কিন্তু যে যুদ্ধে গেলো সে আর ফিরে এলো না। কোন সংবাদ ও পাওয়া গেলো না তাঁর। এদিকে তাঁর প্রেয়সী তাঁরই প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে প্রহর গুনছে প্রতিদিন।আমরা ধরে নিতে পারি সে শহীদ হয়েছে। দেশরক্ষা হলো কিন্তু যুবকের প্রেমিকার প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা হলোনা। দুটি নবীন বয়সী মানুষের মনের সব রঙীন স্বপ্নসাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। এরকম কতো নব্য নওজোয়ান যুবক যুবতীর, নববিবাহিত দম্পতির স্বপ্নসাধ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমের মুল্য দিতে গিয়ে। কে তার হিসাব রেখেছে?


শেষমেষ ঐ প্রিয় পরিজন হারানো মানুষগুলো ও স্বান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন লাল সবুজ পতাকার মুক্ত বাতাসে স্বগর্ব উড্ডয়ন দেখে। কবিতার শেষ স্তবকে কবি এ কথাই জানাচ্ছেন পাঠককে
সর্বশেষ চরনে কবির উচ্চারণ: তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ তোমায় ভালোবাসি। কবিতা গর্ভের বক্তব্যের সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ কথিত শেষ চরন। কবিতার নামকরনেও এই শব্দগুচ্ছের স্বার্থকতা খুঁজে পাবেন পাঠক।
এছাড়া,কবিতাটি বাংলার বনেদী ছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা,যেমনঃ
  যুদ্ধ হলো/বিজয় এলো/স্বাধীন হলো/দেশ।
(*)রক্ত দিয়ে/লেখা হলো/সোনার বাংলা/দেশ।
৪+৪+৪+১
এভাবে আগাগোড়াই,পর পর দুই চরণে অন্তমিল থাকায় কবিতাটি স্বতঃস্ফূর্ত এক গীতিধর্ম লাভ করেছে।
উপরোদ্ধৃত(*)চিহ্নিত পঙক্তিতে লক্ষণীয়:
আমরা স্বাধীনতা মানে কেবল উৎসব দেখি স্বাধীনতার জন্য  আত্মত্যাগের মহিমা ভুলে যাই। কিন্তু কবির কলমের ইশারা সেই আত্মত্যাগের মুল্যায়নের দিকেই।প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, কবি আবুল হাসান রচিত কবিতা"উচ্চারণ গুলি শোকের" থেকে- পূর্বাপর দুয়েকটি চরনঃ
লক্ষী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাটি হাটি শিশুটিকে কোথাও দেখিনা.......ছোটো ভাইটিকে আমি কোথাও দেখিনা।
নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখিনা।
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি।
তবে কি আমার ভাই,আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদিতে উৎসব।


অতঃপর বলা যায়, কবিঃ রুনা লায়লা,আলোচ্য " তুমিই প্রিয় বাংলাদেশ" শিরোনামা কবিতায়। স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ আর আনন্দ উৎসবের এক সমিল আখ্যান বিবৃত করেছেন।


আন্তরিক অভিনন্দন রইলো কবির প্রতি।


* কবি পরিচিতি:
কবি: রুনা লায়লা।
জন্মঃ ৩০ ডিসেম্বর ১৯৮৭ ইং ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার উত্তরানো গ্রামে। পিতাঃ মোঃ আবুল কাশেম। মাতাঃ আনোয়ারা বেগম।  সরকারি তিতুমীর কলেজ ঢাকা থেকে (প্রাণিবিদ্যা বিভাগে)বি এস সি ও এম এস সি, এবং শেখ ফজিলাতুন্নেসা কলেজ থেকে বি এড ডিগ্রী লাভ করেন,পেশায় একজন শিক্ষক। পাশাপাশি পরিসংখ্যান ব্যুরোতে এম এস ভিএস প্রকল্পে ও কাজ করে যাচ্ছেন। শৈশব ও বেড়ে ওঠা শহরে, তথাপি গ্রাম্য প্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে রয়েছে তার অন্তরের মিতালী। সাহিত্য চর্চা অবসরের বিষয় হলেও নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন লিটলম্যাগ, অনলাইন ও ব্লগে। লেখার বিষয় বহুমাত্রিক হলেও মুলত তিনি একজন আপাদমস্তক কবি,মন এবং মস্তিষ্ক জুড়ে থাকে সব সময় কবিতার শতদল।
তাঁর কবিতায় দেশাত্মবোধ মানবতাবোধ প্রেম ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার।
একক প্রকাশনা নিয়তির ডুবুচর। কাব্যগ্রন্থ:কাব্য শতদল, নবদিগন্ত (কোলকাতায় প্রকাশিত) অবনীর শেষ শব্দ সম্ভার, সঞ্চয়ন দ্বাদশ রবির কর।
______________________
আলোচক:
মোঃ সাদিকুর রহমান রুমেন।
কবি ও সমালোচক।
গ্রামঃ জামালপুর,থানাঃ জগন্নাথপুর,জেলাঃ সুনামগঞ্জ।