বিলেত বাসী কবি হাজেরা কোরেশী অপি'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ "মনের সাতকাহন" এর অধিকাংশ কবিতা এই আসরে প্রকাশিত। সেই সুবাদে আসরের অন্যান্য কবিদের মত আমারও কবিতাগুলো ইতস্তত পড়া হয়েছে। অতঃপর গ্রন্থভুক্ত হওয়ায় বইয়ে আরো নতুন সংযোজিত কিছু কবিতার সাথে সকল কবিতা একসঙ্গে পড়ার সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আদ্যন্ত গ্রন্থখানা পাঠ করে কবির কাব্যিক মেজাজ ও মুল্যবোধের একটি সার্বিক নমুনা আমার দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে, এই আলোচনা মোটামুটি তারই "পাঁচকাহন" সাতকাহন বলছিনা এ কারনে যে আলোচ্য গ্রন্থের নাম তাই।


এছাড়া বইয়ে প্রকাশিত সকল কবিতার ষোলকলা পূর্ণ আলোচনা না করে আলোচনার নাম সাতকাহন  বললে অত্যুক্তি হয়ে যায়! কবির গ্রন্থপাঠ পরবর্তী আলোচনা করে এর ষোলকলা পূর্ণ সারাৎসার বর্ণনার অনুরোধ রইলো আসরের অজস্র গুণী কবি রত্ন বর্গের প্রতি। আশাকরি যে সকল সম্মাণিত কবিরা লেখকের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সৌজন্য কপি পেয়েছেন, তারা সময়ে সুযোগে বইটির মুল্যায়নধর্মী আলোচনায় এগিয়ে আসবেন?


আপাতত আমি আমার অভিমত জানাই:
প্রথমেই কবির প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা, আমাকে তিনি অনুজ জ্ঞানে বইটির উৎসর্গ পত্রে অন্যান্যদের সহিত শামিল রেখেছেন এজন্য।
বইয়ের প্রথম কবিতার শিরোনাম "ঈমান বাঁচাই" উল্লেখিত কবিতায় কবি নিজের এবং তার পাঠকের বসত বিচরণের এক সীমানা চৌহদ্দি চিহ্নিত করে ফেলেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। নামধারী মুসলিম না হয়ে খাঁটি   " মুসল্লম" ঈমানদারী মুসলিম হবার একান্ত তাগিদ ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন কবি। অতএব সাবধান হে মুসলমানগণ হুঁশে বেহুঁশে মাতলামি ছাড়ো আর সঠিক পথ ধরো, কবির পরামর্শ মুলত এটাই। নিজের সম্প্রদায় কে হুঁশিয়ার করবার দায়বোধ থেকে এই কবিতা ভুমিষ্ঠ হয়েছে। তথাপি কবির চেতনা মুলত অসাম্প্রদায়িক, মুষ্ঠিমেয় বিতর্কিত পরধর্ম অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চেতনাধারী কিছু ধোঁকাবাজ মানুষ আছে এই জগতে, যারা "লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়াদ্বীন" পবিত্র আল-কোরআন এর এই মহাবাণীর বিশ্বাস ও চেতনার চৌহদ্দির বাইরে এসে, বিপরীতমুখী কথার চাতুরির আশ্রয় নিয়ে, মুসলিম ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করে। অপমান অসম্মান অপব্যাখ্যা দিতে মরিয়া হয়ে রয়েছে। কবি তাদের ধোঁকাবাজি থেকে নিজ ধর্ম সম্প্রদায় কে সাবধান ও সতর্কতার সহিত বেঁচে থাকার চরমপত্র দিয়েছেন, গ্রন্থের সুচনা কবিতায়।


এর পরের দুটি কবিতায়  নিজ পিতা মাতার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন এক সু-সন্তান সুলভ কথামালায়। তৎপরে "আমার জন্মভূমি" কবিতায় ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশের, সুনিপুণ এক চিত্রাঙ্কন করে নিজ দেশমাতৃকা বঙ্গভূমির প্রতি চরম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কবির দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের প্রতি আমি আমার আন্তরিক সংহতি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। দেশপ্রেমিক কবি, তাঁর পরবর্তী অনেক কবিতায় দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব মিলাতে গিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার কথা বলেছেন অকপটে। এছাড়া আপাদমস্তক মানবতাবাদী কবি, আর্তমানবতার অনেক লাঞ্ছনা বঞ্চনার কথা ও তুলে ধরেছেন সোচ্চার কণ্ঠে। কবির সমকালীন যুগে, আর্তমানবতার প্রতি অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন, অবিচার অনাচার, খুন রাহাজানি, জবরদস্তি বলাৎকার, কবির কোমল মন ও মানসে প্রবল নাড়া দিয়েছে। কবি মন এতে সঙ্গত কারণেই আহত ব্যথিত হয়েছে। এসব দুরাচারি কর্মকাণ্ডের আতিশয্য দেখে কবিমন বড়ো বিচলিত। কবি এসব থেকে নিরীহ মানব সম্প্রদায়ের পরিত্রাণ বা মুক্তি চেয়েছেন, তার কবিতার পরতে পরতে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমি কবিকে সাম্যবাদী ও নিজ ধর্ম বিশ্বাসে অটল অথচ অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উচ্চকণ্ঠ মানব দরদী  মানবাধিকারের ভাষ্যকার হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছি, তার রচিত কাব্যগ্রন্থ আগাগোড়া পাঠ করে।


অন্যদিকে রঙ্গব্যঙ্গ কাব্য রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি, সমাজের নানান কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতা ও অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারঙ্গম, চটুল কাব্য ভঙ্গিমায়। কয়েক ঠোঙা ভাজা বাদাম শিরোনামে অনুকাব্য সমাহারে   "কষ্টিপাথর" নামক অনুকবিতায় কবি লিখেছেন:
"কষ্টিপাথর করে যাচাই
মুদি দোকানি কয়
ফেলো ছুঁড়ে দুর পাহাড়ে
কোন কাজের নয়"
এটি একটি ছোট্র নমুনা দিলাম। অন্যান্য কবিতার উদ্ধৃতি দিলে লেখা অনেক দীর্ঘতর হবে তাই ক্ষান্ত দিলাম, তবে একটি ভাত টিপলেই ডেকচির অন্যান্য ভাতের অবস্থা অনুমান করা যায়, সুতরাং ইশারাভি কাফি।


এছাড়া নানান ডাইমেনশনের কবিতায় ভরপুর কাব্যগ্রন্থ 'মনের সাতকাহন' একটিমাত্র গ্রন্থে এত বিচিত্র ভাবনা চিন্তার সমাহার সত্যিই এক বিরল দৃষ্টান্ত।
তাছাড়া গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন কবির মেজ কন্যা সুমাইয়া ইব্রাহিম। কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবির নিজের লেখা  মুখবন্ধ " না বলা কিছু কথা" পড়লেই পাঠক জানতে পারবেন প্রচ্ছদ অঙ্কনের প্রেক্ষাপট।
আমি কোন শিল্পবোদ্ধা নই, সাধারণ দৃষ্টিতে আমার যে অনুভূতি: সুমাইয়া ইব্রাহিম এক অসাধারণ প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী। কারণ কবি মাতার ফরমায়েশ মত সে বইয়ের যথার্থ প্রচ্ছদ অঙ্কন করে দিয়েছে, এ যেন সোনায় সোহাগা।
সর্বশেষ, আমি মাতা পুত্রি দুজনের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি, আর 'মনের সাতকাহন' কাব্যগ্রন্থের সাফল্য, বহুল প্রশংসা ও  প্রচার কামনা করি।


আলোচকঃ
মোঃ সাদিকুর রহমান রুমেন
কবিও‌ আলোচক
সম্পাদক দর্পণ ও সাধারণ সম্পাদক
আলোকিত সাহিত্য পরিবার।