গল্পটা শুনেছিলাম মায়ের কাছে -
মেজদা তখন মায়ের পেটে
কাঠের উনুনের আগুনের পাশে বসে
হাত গরম করতে করতে
গল্প শুনে মাথাটাও যেন গরম হয়ে উঠতো
মা বলতেন -
একদিন তর বাবায় বাড়িতে ঢোকতে ঢোকতে
চিৎকার কইরা কইতাছে
কেন - ছাড়ুম কেন?
জন্ম থিক্যা যেইডা শিক্ষা আইছি
হেইডা অহন ছাড়ুম কেন?
মা তখন জিজ্ঞেস করলেন
কি ছাড়নের কথা কইতাছো
বাবা তখন রাগে গজগজ করে বলতেন
হালা, এতদিন ধইরা আমরা বাংলায় কথা কইতাছি
বাংলায় লেহা পড়া কইরা আইছি
আমাগো সব কিছু বাংলায়
আর অহন কিনা কইতাছে
আমাগো আবার নতুন কইরা উর্দু সেহন লাগবো!
অফিস কাছারিতে
ইস্কুল কলেজে সব জায়গায়
অহন থিক্যা বলে
পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু চালাইবো
কথাটা শুনে মায়ের মাথাটাও গরম হয়ে যেত।
আর সেই রাগ গিয়ে পড়তো
হাতের বেলনির উপর
রুটিটা তখন হয়ে যেত ত্যারা ব্যাকা।

বাবা তখন মাকে থামিয়ে বলতেন
তুমি চিক্কর পাইরো না
পেডের সাওয়ালডার ক্ষতি হইয়া যাইবো
অরা তো আছে - আব্দুল জব্বাররা
আমরাও আছি অগো লগে
কিছুতেই ছাড়ুম না আমাগো এই মাতৃভাষা
হালারা আহুক না আমাগো অন্য ভাষা শিখাইতে
ঝাড়ের বাঁশ আছে না
দিমু এক্কেবারে মাথাগুলি ফাডাইয়া

মা তখন সেই গরম মাথা নিয়ে বলতেন
তোমরা একলা যাইবা কেন
আমরাও যামু তোমাগো লগে
দেহুম, কোন ব্যাডারা আহে
আমাগো অন্য ভাষা শিখাইতে
আমাগো যেমুন
বাড়ির অধিকার আছে
ভাতের অধিকার আছে
তেমুন আমাগো নিজের ভাষায় কথা কওনেরও অধিকার আছে
ছাড়ুম না এই অধিকার,কিছুতেই না।

গল্পটা শুনতে শুনতে মাথাটা গরম হয়ে যেত
শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটে উঠতো
মা সেটা বুঝতে পেরে তখন আবার বলতেন
নারে - শেষ পর্যন্ত অরা পারে নাই
আমাগো ভাইগুলি, পোলাগুলি
হেদিন দিছিলো একখান লড়াই বটে
বরকত সালামরা পরান দিছে
পরান দিয়া অরা মান রাখছে
আমাগো ভাষা অধিকার পাইছে
হের পর থিক্যাই এই ভাষা আন্দোলন
দুনিয়া জুইড়া প্রতিষ্ঠা পাইছে।

মায়ের গল্পের শেষে
উনুনের আগুন তখন নিবু নিবু
বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি
এক ফালি চাঁদের সেই মাতাল হাসি
একুশের আন্দোলনে মিলে যায় তখন সব ভাষাভাষী।