নীল দিগন্তে শ্যামঘন মেঘে,
জন্ম নেয় এক অলিখিত বেদনা,
যাহা শ্রবণে ধরা দেয় না—
অনুভবে রাখে রাগরেখা।

মৌন ঝর্ণার ঢেউয়ের মতো,
সে আসে—নেই তার নামধাম,
ধূপস্নিগ্ধ কুঞ্জবনে
অশ্রুজলে সে রাখে দান।

তারে চাহি না চোখে, জানি—
চোখ তো কারাগার,
তারে ধরি না স্পর্শে, জানি—
স্পর্শ তো মিথ্যার সংসার।

সে তো প্রেম নয় কেবল,
সে এক অরূপ তপস্যা,
ভঙ্গুর হৃদয়ের মাঝে
যে জাগায় আত্মোৎসর্গের ভাষা।

তবু, গোপন সে নিঃশ্বাসে
বেজে ওঠে শ্রুতিসীমার বাঁশি,
তবু রাধার নিঃশব্দ দৃষ্টি
হয়ে ওঠে করুণ অর্ঘ্যরাশি।

সখীগণ, জেনে রেখো—
সে যে লীলার চাতুর্যে বিভ্রম সঞ্চারে,
প্রকৃতি তার খেলার রঙ্গমঞ্চ,
প্রেম তার অদৃশ্য চরিত্রভারে।

সে হাসে না, সে ব্যথা দেয় না—
সে শুধু রসের প্রগাঢ় বিস্তার,
চূর্ণ হৃদয়েই জন্ম নেয়
অনন্ত সুখের অগ্নিস্নান-স্নিগ্ধ ভার।

অরণ্যে যেমন সন্ধ্যাপ্রভা,
ধীরে ধীরে ঢলে পড়ে নদীতে,
তেমনি সে প্রেম—অভিশপ্ত নয়,
অবিশ্বাস্যও নয়, কিন্তু অনির্বচনে রচিতে।

শিরায় শিরায় প্রেম নয়,
সে তো চেতনার গভীর বিভা—
যেখানে রাধার নয়নজলে
এক মহাকাল দাঁড়ায় নিঃশব্দ শ্রদ্ধা।

সে যদি আসে, প্রেম করে না—
সে মুছে দেয় সব কিছু,
নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব—
শুধু রেখে যায় নিরাশ্রয় এক হৃৎপিন্ড।

সে প্রেম অন্ধ নয়, নয় উন্মাদনা,
সে এক আত্মা-নমিত কণ্ঠস্বরে—
নীরবতার গীত, যা শ্রুতির অতীত,
আর রূপের চেয়েও রূপহীন মধুর।

যে ফুল ফোটে, সে ঝরে—
প্রেম ঝরে না, সে রয়ে যায়,
শ্রীচরণে ধূলি হয়ে,
কিংবা স্তব্ধ প্রার্থনার অঞ্জলি হয়ে।

তাহার আশ্রয় নয় বাহুর ভিতর,
তাহার বাস হৃদয়-অভ্যন্তরে,
যেখানে জোছনা মুখ লুকায়,
আর কামনা পুড়ে হয়ে যায় অর্ঘ্যরূপে।

প্রেম না থাকিলেও—
সে যে ‘প্রেমের অনুপস্থিতি’তেই বিরাজমান,
কারণ সেই শূন্যতা, সেই দহনই
প্রেমের পরম প্রমাণ।