জন্ম থেকে জীবনের নিতুই প্রবাহে
শুনেছি স্বাধীনতার নানা কথা।
মুজিবুর থেকে বঙ্গবন্ধু, একটি জাতির পিতা,
সাত-ই মার্চের উত্তাল জনতা।
শুনেছি পরাধীনতার রক্তইতিহাস,
পাক-হায়েনার হিংস্র বর্বরতা।


সেদিন শীতের বিকেল বেলাতে
বিষাদ স্মৃতির বারান্দাতে বসে
পাড়ার জ্যাঠামশাই হৃদয়ের পাণ্ডুলিপি খুলে
বলে যান স্বাধীনতার না বলা কথা।


মাঝেমাঝে খকখক কাশি,
মুখে নেই যৌবনের হাসি
বললেন তিনি-
"ছাড়তে চেয়েছি  বাস্তুভিটে;
কিন্তু, ছাড়তে পারিনি।"


"আগুন লাগালো প্রতি ঘরে ঘরে।
কেউ পুড়ে মরে আগুনের উজান প্রপাতে,
কেউ ঝাঁঝরা হয় বুলেটের আঘাতে আঘাতে,
কেউ ঠিকানা খুঁজে অচেনা পথে,
ছুটছে মা-বোন এদিকওদিক প্রাণ নিয়ে হাতে।"


"সবাই পালাতে চায়,
কিন্তু, খুঁজে পায় না ঠিকানা।
বেরোবার পথগুলো দখলে রেখেছে
সেই একাত্তরের হায়েনা।"


"এমন তিমির পড়ন্ত বিকেলে
করিম চাচা ও আমি তুলে নিই হাতে
ঘরে রাখা রাইফেল।
মাথায় বেঁধে নিই পতাকা, গামছার আদলে,
সমানে সমান যুদ্ধ করি গোলাবারুদের সাথে।"


"সেদিনের স্মৃতি টকটকে তাজা
এখনও হয়ে যায়নি পর।
পুড়ছে, দাউদাউ করে পুড়ছে...
পুড়ে যাচ্ছে মানুষের কাঁচাঘর, পাকাঘর।"


তোর জ্যাঠাইমা চিৎকার করে বললো,
"বাঁচাও... বাঁচাও... বাঁচাও.....।"
"আমি কিচ্ছুটা করতে পারিনি।
তাকেও তারা ছাড়েনি।"


"মা-বাবা, আমাদের সন্তান, ভাই-বোন সবমিলে
পঁচিশজনের যৌথপরিবার।
গোলাবারুদের শব্দে শব্দে
কিছুই করতে পারিনি আঁচ,
অবশেষে হিসেবখাতায়- আমি-সহ শুধু পাঁচ,
এখন আমার নেই কিছু আর হারাবার।"


জ্যাঠাবাবুর দু'চোখ বেয়ে জল....
হিসেবের পাতাগুলো যাচ্ছে ভিজে,
কারও চোখে কষ্ট, কারও চোখে দ্রোহ,
কারও চোখ শিশিরের মতো টলমল,
তবুও, আমার চোখে আসেনি কোন জল।


বিশ্বনাথ কাকু, ও পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা কোন একদিন
কাঁদতে কাঁদতে হারালেন খেই,
আমাদের বললেন-
"আমি ছাড়া বাপের ভিটেতে আর কেউ নেই।"


"চার বছরের সোনাধন ফেলে,
মুখে চুমো খেয়ে গিয়েছি মুক্তির খোঁজে।"
তোর কাকী বলেছিল হাত ধরে,
"ফিরে যদি আসো, আমার সোনার জন্য
কিনে দিও একটা পাতার বাঁশি।"
"আমার এখন আছে শুধুই  বিষাদের হাসি।"


"যুদ্ধ শেষে আমি বাড়িতে এলাম ফিরে,
চারপাশে দাঁড়িয়ে সবাই  ধরলো আমাকে ঘিরে।"
পাড়ার বন্ধু সজল বললো আমাকে-
"যাসনে বিশ্ব ওই পোড়াবাড়িতে।
নেই নেই কেউ নেই, নেই কোন প্রাণ,
আছে শুধু মানুষের পোড়া ঘ্রাণ।"


"তবুও গেলাম ছুটে সেই পৈতৃক ভিটিতে।"
যে আমার গন্ধ শুঁকে আসতো উঠোনে,
বলতো," ফিরলে কেন এতো দেরিতে?"
"আর আমি চুপিসারে ধীরেধীরে তার হাত ধরে
ঢুকে পড়তাম একটি সুনিদ্র ঘরে,
মুক্তোর মুখখানি দেখে নিতাম আলোকিত ল্যাম্পে।"
"হয়তো সে আর আসতে পারেনি.....
শুনেছি তাকেও নিয়ে যায়
কোন এক মিলিটারি ক্যাম্পে।"


"খুঁজেছি ঘরের মাঝে এখানে-সেখানে,
সে আমার ফেলে যাওয়া সোনাধন,
সে যে হৃদয়ের চেয়ে দামি,
জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে থাকা আলাপন।
যে গন্ধ আমাকে এনে দেয় শান্তি সীমাহীন,
যে গন্ধে মিশে আছে  অস্তিত্ব অমলিন,
সে আমার সোনা-যাদুধন
যার সাথে কাটাতাম প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।
সেই গন্ধটুকু আজ পেলাম না খুঁজে
সবখানে  ঘুরে,
খুঁজেছি, খুঁজেছি,  খুঁজেছি বাড়ির চারিধারে,
বারবার আমি খুঁজেছি তারে এধারওধারে।"


সবাই সেদিন কেঁদেছিল বিশ্বনাথ কাকুর কথায়,
আমি শুধু নির্বাক ছিলাম তাঁর জমানো ব্যথায়।
অবিশ্বাস্য মন চেয়ে দেখে হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢালি,
দু'চোখে তাঁর দেখেছি আমি
ঝরে পড়া বিষাদের কালি।
আমারও চোখে জল আসবে এমন....
কিন্তু, এসে গেলো শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা!!
সেই পাকিদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা, প্রচণ্ড ঘৃণা......।
---------------------------------
রচনাঃ ০২/১১/১৮ ইং, চট্টগ্রাম।