💄অক্ষরবৃত্ত ছন্দঃ-   বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই ছন্দরীতিতে রচিত কবিতার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ছন্দ-সচেতন আধুনিক কবিরা এই রীতিতেই অধিকাংশ কবিতা লিখে থাকেন ।


         অনেকে এই ছন্দকে  তানপ্রধান ছন্দ বলে থাকেন । রবীন্দ্রনাথ বলতেন সাধু ছন্দ, কখনও বা বলতেন পয়ার ছন্দ । তবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নামেই সমধিক পরিচিত। যদিও এই নাম নিয়েও  যুক্তিসংগত বিতর্ক আছে। কেননা একসময়ে মনে করা হত, এই রীতিতে অক্ষরের সংখ্যা আর মাত্রার সংখ্যা সমান । কিন্তু পরবর্তী কালে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে । এই রীতিতে রুদ্ধদলের উচ্চারণের মিশ্র চরিত্রের কথা মাথায় রেখে আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন এই ছন্দরীতির নাম দিয়েছেন 'মিশ্র কলাবৃত্ত' বা 'মিশ্রবৃত্ত'। আমার মতে এটিই সঠিক নামকরণ। তথাপি অধিক পরিচিতির কারণেই "অক্ষরবৃত্ত" নামটিকেই বহাল রাখলাম।


        অন্যদুটি রীতির মতই অক্ষরবৃত্ত রীতিতেও প্রতিটি মুক্তদল একমাত্রা হিসাবেই গণ্য হয়। অর্থাৎ তিনটি রীতিতেই মুক্তদল সর্বদাই একমাত্রা হয়। কিন্তু রুদ্ধদলের ক্ষেত্রে এই রীতির  নিয়ম অন্য  দুটি  রীতির মত নয়। এই রীতিতে রুদ্ধদল কখনো এক আবার কখনো দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। ব্যাপারটা তেমন জটিল নয়, বরং খুব সহজঃ-
         রুদ্ধদল  শব্দের প্রথমে আর মাঝে থাকলে
                    হবে একমাত্রার।
                    এবং  শব্দের শেষে অথবা একা
                    একা থাকলে হবে দুই মাত্রার।


        মুক্তদল   যেখানেই থাক সর্বদাই একমাত্রা
                    হিসাবে গণ্য হবে।


      দৃষ্টান্তঃ-  
      
     "ভালোমন্দ দুঃখসুখ অন্ধকার আলো
      মনে হয় সব নিয়ে এ ধরণী ভালো"
আমরা আগেই দলনির্ণয় শিখে ফেলেছি।
সুতরাং প্রথম পঙক্তির দল বিশ্লেষণ হবে নিম্নরূপ --
    ভা(মুক্তদল ) + লো(মুক্তদল ) + মন্(রুদ্ধদল ) + দ (মুক্তদল ) /  দুখ্ (রুদ্ধদল ) + খ (মুক্তদল ) + সুখ্ (রুদ্ধদল ) / অন্ (রুদ্ধদল ) +  ধ (মুক্তদল)+ কার্ (রুদ্ধদল ) / আ (মুক্তদল)+ লো (মুক্তদল)
--
ভালোমন্দ = রুদ্ধদলটি (মন্ ) শব্দের মাঝে আছে।সুতরাং এক্ষেত্রে রুদ্ধদল  একমাত্রা । অর্থাৎ শব্দটি মোট 1+1+1+1=4 মাত্রার ।
--
দুঃখসুখ = দুখ্ ( রুদ্ধদলটি শব্দের প্রথমে আছে। সুতরাং এটিও এক মাত্রা ।
            সুখ্ ( এই রুদ্ধদলটি কিন্তু শব্দের শেষে আছে। এটি হবে দুই মাত্রা । অর্থাৎ শব্দটির মাত্রাসংখ্যা হবে 1+1+2 = 4


         এবার দ্বিতীয় পঙক্তির ক্ষেত্রে--
ম (মুক্তদল )+নে (মুক্তদল )+ হয় (রুদ্ধদল ) /
সব (রুদ্ধদল ) নি (মুক্তদল ) + য়ে (মুক্তদল ) /
এ (মুক্তদল ) + ধ (মুক্তদল ) + র (মুক্তদল ) + ণী(মুক্তদল ) /  ভা (মুক্তদল ) + লো (মুক্তদল )।
--
মনে হয় ( 'হয়' রুদ্ধদলটি একা একা আছে। সুতরাং এটি দুই মাত্রার মর্যাদা পাবে। অর্থাৎ পর্বটির মাত্রাসংখ্যা হবে 1+1+2 = 4
--
সব নিয়ে ( এখানেও 'সব্' রুদ্ধদলটি একা একা আছে । সুতরাং দুই মাত্রা হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ
পর্বটির মোট মাত্রাসংখ্যা হবে 2 +1 +1 = 4


সুতরাং পঙক্তিদুটির পর্ব বিভাজন হবে নিম্নরূপঃ-


ভালোমন্দ / দুঃখসুখ /অন্ধকার / আলো 4+4+4+2
মনে হয় / সব নিয়ে / এ ধরণী / ভালো। 4+4+4+2


* এই ছন্দরীতিতে  পর্বের মাপ  চার মাত্রা রাখাই শ্রেয়।
-----------
কয়েকটি দৃষ্টান্তঃ-


জানিতে চাহিনা আমি কামনার শেষ কোথা আছে
ব্যথায় বিবশ তবু হোম করি জ্বালি কামানল
                    (মোহিতলাল মজুমদার )


পর্ব বিভাজন করে দেখা যাক-


জানিতে চা/ হিনা আমি /কামনার /শেষ কোথা /আছে     4+4+4+2
ব্যথায় বি/বশ তবু/ হোম করি/ জ্বালি কামা/নল  4+4+4+2!
-----
সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ;
সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
          (জীবনানন্দ দাশ )


    কবি পর্ব ভাগ করেছেন এইভাবে -


সুচেতনা/ তুমি এক/ দূরতর /দ্বীপ      4+4+4+2
বিকেলের /নক্ষত্রের /কাছে ;            4+4+2
সেইখানে /দারুচিনি /বনানীর /ফাঁকে  4+4+4+2
নির্জনতা /আছে।                          4+2
--------
        * মাত্রাবৃত্ত রীতির আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, সেখানে পর্বের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন মাপের হয়ে থাকে । কিন্তু  অক্ষরবৃত্ত রীতিতে পর্বের দৈর্ঘ্যের  ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র্য নেই। এই রীতিতে  পূর্ণ পর্বের মাপ সাধারণত চার মাত্রারই হয়। একসময়ে এই রীতিতে চার মাত্রার বেশি মাপের পর্বও দেখা যেত । কিন্তু তা বাংলা উচ্চারণ-স্বভাবের অনুকূল ছিল না। ফলে সেগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক শোনাত। কেউ কেউ এই রীতিতে আট মাত্রার পর্বের কথা বলে থাকেন, কিন্তু এই ধারণাটাও ঠিক নয়। অনেক সময়েই পর্বযতি (পড়ার সময় যেখানে একটুখানি থামতে হয়)  ঠিক মত বোঝা যায় না, এইসব ক্ষেত্রেই কেউ কেউ দুটি পর্ব জুড়ে আট মাত্রার পর্ব হিসাবে দেখান।  কিন্তু ধারণাটি ভুল। যেমন --  
      "একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ
       পড়িবে নয়ন পরে অন্তিম নিমেষ"
দ্বিতীয় পঙক্তিতে 'নয়ন' শব্দটির ন-এর পরে পর্বযতি কাঙ্খিত ছিল । কিন্তু এখানে সেটি লোপ পেয়েছে । আবার পঙক্তিটির পরের অর্ধে 'নিমেষ' শব্দটির 'নি'র পরেও এরূপ ঘটেছে। তবু পঙক্তিদুটির যুক্তিসংগত পর্ব বিভাজন  হবে নিম্নরূপ --
একদিন/ এই দেখা / হয়ে যাবে / শেষ 4+4+4+2
পড়িবে ন/ য়ন পরে/ অন্তিম নি/ মেষ   4+4+4+2


      আমরা আগেই জেনেছি যে, এই রীতিতে পর্বের মাপের ক্ষেত্রে তেমন কোন বৈচিত্র্য নেই । কিন্ত ছন্দরূপের বৈচিত্র্য সৃষ্টির ব্যাপারে এই অক্ষরবৃত্ত রীতির আর কোন জুড়ি নেই ।কারণ এই রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শোষণক্ষমতা । ফলে এই রীতিকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে পয়ার, মহাপয়ার, মুক্তক প্রভৃতি ছন্দরূপ ।  যদিও অন্য দুটি ছন্দরীতিতেও পয়ার বা মহাপয়ার রচিত হতে পারে, তবে অক্ষরবৃত্তের প্রয়োগই বেশি । এখন প্রশ্ন হল 'শোষণক্ষমতা ' ব্যাপারটা কি? খুব সহজ । পঙক্তির মধ্যে পর্বে পর্বে রুদ্ধদলকে সংকুচিত করে জায়গা করে দেওয়ার ক্ষমতাই হল শোষণক্ষমতা । আমরা আগেই জেনেছি যে,  এই রীতিতে প্রথম ও মাঝের রুদ্ধদল এক মাত্রার হয়। ফলে শব্দের মধ্যে অধিক পরিমাণ ধ্বনিকে বহন করা যায়। অক্ষরবৃত্ত রীতির শোষণক্ষমতার এই ব্যাপারটিকে রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেনঃ-
'পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে ' 14 মাত্রার এই পঙক্তিটির মূল কাঠামো বজায় রেখেই তিনি রুদ্ধদলের সংখ্যা বাড়িয়েছেন ক্রমশ --
'পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে'
'পাষাণ মুর্ছিয়া  যায় গায়ের বাতাসে'
'পাষাণ মুর্ছিয়া  যায় অঙ্গের বাতাসে'
'পাষাণ মুর্ছিয়া  যায় অঙ্গের উচ্ছ্বাসে'
'সঙ্গীত তরঙ্গি উঠে অঙ্গের উচ্ছ্বাসে'
'সঙ্গীত তরঙ্গ রঙ্গ অঙ্গের উচ্ছ্বাসে'
--
লক্ষ্য করুন, 1ম পঙক্তিতে রুদ্ধদলের সংখ্যা 3 (ষাণ্, যায়, য়ের্)
2য় পঙক্তিতে 4 ( ষান্, মুর্, যায়, য়ের্)
3য় পঙক্তিতে 5 (ষান্, মুর্, যায়, অঙ, গের্)
4র্থ পঙক্তিতে 6 (ষান্, মুর্, যায়, অঙ, গের্ উচ্)
5ম পঙক্তিতে 6 (সঙ, গীত্, রঙ, ,অঙ, গের্, উচ্)
6ষ্ঠ পঙক্তিতে 7 (সঙ, গীত্, রঙ, রঙ,অঙ, গের্,
--
এই কাঠামো বজায় রেখেই আরও রুদ্ধদল যে জায়গা পেতে পারে তারও দৃষ্টান্ত দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ -
'দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত'।
এই পঙক্তিটিতে রুদ্ধদলের সংখ্যা 9টি
(দুর্, দান্, পান্,ডিত্, পূর্, দুস্, সাধ্, সিধ্ , ধান্)
অথচ বাক্যটিত মাত্রা-সংখ্যা  মাত্র 14
      এইভাবে অক্ষরবৃত্ত রীতিতে রুদ্ধদল-সংকোচনের একটা সুযোগ থেকে যায়। যার আর এক নাম শোষণক্ষমতা ।
সুতরাং যাঁর ভাঁড়ারে সমার্থক শব্দের স্টক যত বেশি তিনি এই ছন্দরীতির তত বেশি সুবিধা নিতে পারবেন।
------
এই রীতির  আরও  কয়েকটি  দৃষ্টান্তঃ-


হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিও না ধরে (রবীন্দ্রনাথ )
পর্ব বিভাজন --


হে স্নেহার্ত/ বঙ্গভূমি /তব গৃহ/ক্রোড়ে  4+4+4+2
চিরশিশু/ করে আর /রাখিও না /ধরে  4+4+4+2
--
(যেসব অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী কবিতায় পঙক্তিগুলির দৈর্ঘ্যে  কোন সমতা থাকে না সেইসব কবিতাকে সাধারণত 'মুক্তক' বলা হয়ে থাকে । এবার এরূপ একটি মুক্তকের দৃষ্টান্ত দিলাম --


অলস সময়-ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোক
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে ।
--
পর্ব বিভাজন--
অলস স/ ময়-ধারা / বেয়ে          4+4+2
মন চলে / শূন্য-পানে / চেয়ে        4+4+2
সে মহাশূ/ ন্যের পথে /ছায়া-আঁকা/ ছবি পড়ে /চোখে।       4+4+4+4+2
কত কাল / দলে দলে / গেছে কত / লোক   4+4+4+2
সুদীর্ঘ অ/ তীতে               4+2
জয়োদ্ধত /প্রবল গ/তিতে।    4+4+2
---
মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকল রবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড় ধরে থাকে হাল
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে পাকা ধান কাটে।
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে ।
--
পর্ব বিভাজন--


মাটির পৃ/ থিবী-পানে /আঁখি মেলি /যবে 4+4+4+2
দেখি সেথা/ কলকল /রবে    4+4+2
বিপুল জ/নতা চলে     4+4
নানা পথে /নানা দলে /দলে    4+4+2
যুগ যুগা/ন্তর হতে /মানুষের /নিত্য প্রয়ো/জনে 4+4+4+4+2
জীবনে  ম/রণে।   4+2
ওরা চির/ কাল      4+2
টানে দাঁড় / ধরে থাকে/ হাল  4+4+2
ওরা মাঠে/ মাঠে      4+2
বীজ বোনে /পাকা ধান /কাটে। 4+4+2
ওরা কাজ /করে            4+2
নগরে প্রা/ন্তরে ।            4+2
----------------'--'--------------------
🔯 উল্লেখ্য,  আধুনিক ধারণায় পয়ার অথবা মহা পয়ার কোন ছন্দরীতি নয়, পর্ববিণ্যাসের বিশেষ পদ্ধতি মাত্র, যা আলোচিত তিনটি ছন্দরীতির যেকোন রীতি অবলম্বন করেই গড়ে উঠতে পারে ।


⏳পয়ারে পর্ববিণ্যাস   8/6  এবং
    মহাপয়ারে   8/10