জীবনানন্দের কবিতায় উঠে এসেছিল প্রতারক নারীর কথা আর নবীন কবি শাশ্বতী সান্যালের কবিতায় উঠে এল প্রতারক পুরুষের কথা:-


মেটিং কল
      - শাশ্বতী সান্যাল


তোমার ছবির কাছে সাজানো রয়েছে
এই বনাঞ্চল, কৃষ্ণসার আলো


যতদূর সুঁড়িপথ
যতদূর ঘাসে ঘাসে চিতার বিভ্রম
টুরিস্ট বাসের আলো থেমে গেছে তার বহু আগে


আপাতত সঙ্গীহীন


থাবা থেকে বাঘ-নখ খুলে নিয়ে তুমি ঘুমিয়েছ


সন্ধের খানিক পরে শালের জঙ্গলে উঠবে
দ্বাদশীর রোগা চাঁদ, তবু
আলোর দাক্ষিণ্য এত ভাল নয়। কৃপণতা দাও।
জঙ্গলের ভাঙাচোরা সেতুটার বুকও দেখো
জলশূন্য । নেটওয়ার্ক নেই।


বৃষ্টিহীন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে শুকনো কাঁকর


তোমার ছবির কাছে পড়ে আছে নীরবতা, উপদ্রুত মেঘ

আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
অদূরে মেটিং কল -- বেজে যায়, ব্যর্থ বেজে যায়...


**************
  কৃত্তিবাস পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত এই কবিতাটি পড়ার পর অসম্ভব ভালো লাগে। চিত্রকল্প ও উপমাগুলি দাগ কেটে যাওয়ার মত। তবু কিছুটা ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছিল। অথচ কবির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া নাকি ঠিক নয়। তখন মনে হল, আচ্ছা যদি অন্য কোন কবির কাছে এই কবিতার ব্যাখ্যা চাওয়া হয় তাহলে কেমন হয়! তাছাড়া এক কবির কবিতা অন্য কবি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন সে ব্যাপারেও একটা কৌতূহল থাকেই। তখন কবি অধ্যাপক উত্তম দত্তকে নিজের ইচ্ছার কথা জানাই। তিনি বলেন, ঠিক আছে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখে এফবি তে পোস্ট দেব। তাঁর ব্যাখ্যাটি এত ভালো লেগেছিল যে মনে হলো ভাল লাগাটা সকলের সাথে ভাগ করে নিই :-


একটি ভয়ংকর বিষাদ ও নিঃসঙ্গতার কবিতা পড়লাম। পড়তে পড়তে মনে হল, যে এই  কবিকে আমি ঠিক চিনি না। বাইরে অসম্ভব কৌতুকপ্রিয় অথচ লেখার টেবিলে বসলেই সে এক গভীর গহন জগতে পৌঁছে যায়। সেখানে তার নাগাল পাওয়া আমার মতো অলস পাঠকের পক্ষে বেশ দুরূহ।


এই কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার স্বভাবতই মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের অতিশয় বিতর্কিত ' সেই ক্যাম্পে' কবিতাটির কথা। ১৯৩২ সালে বিষ্ণু দে-র অনুরোধে কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এবং সজনীকান্ত দাশ ভালোভাবে নিতে পারেননি এই কবিতার মর্মার্থ। সম্পূর্ণ অকারণেই অশ্লীল বলে চিহ্নিত হয়ে রইল কবিতাটি।(হয়তো তৎকালীন দৃষ্টিতে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না)।


এই কবিতায় ঘাই হরিণীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে শিকারীদের পুরুষ-হরিণ শিকারের একটা আশ্চর্য রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। 'ঘাই' একটি অসমীয়া শব্দ। ঘাই হরিণী হল টোপ হিসেবে ব্যবহৃত  মেয়ে হরিণ। শিকারীর প্ররোচনায় ঘাই হরিণীর কৃত্রিম  ডাক শুনে যৌন তাড়না নিয়ে ছুটে এসে বন্দুকের গুলিতে অসহায়ভাবে মারা যায় পুরুষ হরিণেরা। জীবনানন্দ লিখেছেন :


"আমার হৃদয় এক পুরুষ হরিণ/ পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে / চিতার চোখের ভয় -- চমকের কথা / সব পিছে ফেলে রেখে/ তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?... / মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি"...


ভাই অশোকানন্দ জানিয়েছেন, মুনিরুদ্দি নামে এক শিকারীর কাছ থেকে কবি জেনেছিলেন ঘাই হরিণীর টোপ ব্যবহারের কৌশলের কথা। (কেবল পড়লেই হবে না সার্থক কবিতা লিখতে হলে এভাবে চোখ কান খোলা রেখে অনেক কিছু জানতেও হয়)।


শাশ্বতীর কবিতাটির নাম 'মেটিং কল'। শুনে মনে হতে পারে এটি একটি যৌনতাড়নার বা যৌন আহ্বানের কবিতা। কিন্তু বিচক্ষণ পাঠকমাত্রেই লক্ষ করবেন এটি আদতে একটি প্রতারণার কবিতা, চরম নিঃসঙ্গতার কবিতা, অবিশ্বাস আর সন্দিগ্ধ মনের নিরভিসারের কবিতা।


শাশ্বতীর কবিতায় গদগদ বা বিশুদ্ধ প্রেম কোনোকালেই ছিল না।  একটি দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার সব প্রেমের কবিতাই বস্তুত অবিশ্বাস, সন্দেহ, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা আর বিষাদের শিল্পভাষ্য। তার জীবন ও যাপন তাকে হয়ত এই নেতিবাচক পাঠই শিখিয়েছে।


এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ক্যাম্পে কবিতা বিষয়ে জীবনানন্দের নিজের ব্যাখ্যাটির একটি অংশ :


" যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এই কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের- কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসঙ্গতার সুর।"


এই কথাগুলি হয়ত শাশ্বতীরও মর্মের কথা।


তবে একটু পার্থক্য আছে দুটি কবিতার মর্মে। এখানে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কায় ক্লিষ্ট হয়েছে কবিতার মেয়েটি। আর মেটিং কল ভেসে আসছে পুরুষটির কাছ থেকে। এইখানেই দুটি কবিতা দুই পথে চলে গেল।


শাশ্বতীর আরও একটি কবিতায় ঘোড়ার রূপকে প্রতারক পুরুষের মেটিং কলের কথা আছে। যে ঘোড়া মাঝরাতে অন্যের নারীকে ডাক পাঠাচ্ছে। তাদের সেই যৌন সঙ্গমের দৃশ্যে পাছে নিজের অপমানিত সত্তাকে দেখতে হয়, তাই সেই কবিতার মেয়েটি ঘৃণায় ও বিবমিষায় চোখ বন্ধ করে স্বেচ্ছায় অন্ধ হয়ে থাকে :
"ঘাসের আদল দেখে ইদানীং ঋতুপরিবর্তন বুঝতে পারি
মাঝরাতে হ্রেষা শুনলে মনে হয় আমারই বান্ধব
দূরের বারান্দা থেকে ডাক দিচ্ছে অন্যের নারীকে
তাদের মিলনদৃশ্যে নিজেকে দেখব, এই ভয়ে ইদানীং  চোখ বুজে থাকি...


গোলার্ধে রাত বাড়ে।  দিন ছোটো হয়"


(অশ্বজাতক)



বোঝা যাচ্ছে পুরুষের এই যৌন আহ্বানকে শাশ্বতীর কবিতার প্রোটসগোনিস্ট নারী চরিত্রটি আর পাঁচটা 'কুসুমের' মতো  নির্বিচার শরীরী উল্লাসে গ্রহণ করতে পারেনি।


শৈশবে দেখেছি আদিবাসীরা মাদি ঘুঘুর চোখ কানা করে দিয়ে ঝোপের আবডালে বসানো মায়া পিঞ্জরে রেখে দিত। দুপুরের নির্জন রোদে তার ডাকে সাড়া দিয়ে সঙ্গম করতে এসে ঘন্টা চারেকের মধ্যে শিকারীর হাতে ধরা পড়ত অন্তত ১০/১২ টি পুরুষ ঘুঘু।


কিন্তু এখানে, এই কবিতায়, নারী নয়, প্রতারক পুরুষই যেন কৃত্রিমভাবে যান্ত্রিক ডাক পাঠাচ্ছে কবিতার নারীটির কাছে। এবং মেয়েটির বিশ্বাস সেই ডাকে হত্যালিপ্সা আছে,  রিরংসার মাদকতা আছে, কিন্তু অলকানন্দার স্রোতে ভেসে যাবার মতো হৃদয়-মন্থিত প্রেম নেই।


শাশ্বতীর কবিতায় প্রেমিকের বাঁশির সুর সেই প্রতারক মেটিং কল। একটা দুর্মোচ্য ফোবিয়া তার প্রেমের কবিতায় মুঠো মুঠো অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়।


শুরুতেই রয়েছে : " তোমার ছবির কাছে সাজানো রয়েছে এই বনাঞ্চল,  কৃষ্ণসার আলো"


সামনের এই ছবি, সাজানো বনাঞ্চল প্রথম থেকেই একটা কৃত্রিমতার বিরূপ অনুষঙ্গ সৃষ্টি করে। 'কৃষ্ণসার আলো' শুনেই মনে পড়ে এই হরিণ রঙ বদলায়। বর্ষায় সে থাকে কালো, শীতে ক্রমশ বাদামি। তাহলে এই যে পুরুষ হরিণের আহ্বান, সেও বর্ণচোরা, বিভ্রান্তিসঞ্চারী।


চিতাবাঘের উল্লেখ আর টুরিস্ট বাসের সতর্ক বিরতি সেই বিরূপতা আর সংশয়কেই সুস্পষ্ট করে তোলে। ফলত নিয়তির মতো অনিবার্য হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা।  আর দূর থেকে মনশ্চক্ষে মেয়েটি দেখে :  থাবা থেকে বাঘনখ খুলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পুরুষটি।


তারপরেও শালের জঙ্গলে উঠে আসবে দ্বাদশীর রোগা চাঁদ। ছড়িয়ে পড়বে অলৌকিক অরণ্য জ্যোৎস্নার মহিমা। কিন্তু সেই অপার্থিব সৌন্দর্যকেও সহজভাবে নিতে পারছে না মেয়েটি: " তবু আলোর দাক্ষিণ্য এত ভালো নয়, কৃপণতা দাও"...


এভাবেই সংশয়ের কালান্তক ঘেরাটোপ থেকে বেরোতেই পারে না সে। তার চোখে ভেসে ওঠে নির্জলা ভাঙা কাঠের সেতু এবং নেটওয়ার্কহীন এক বিচ্ছিন্নতার ভুবন।


শরীরের অন্ধিসন্ধিতেও সে অনুভব করে চরম রুক্ষতা, জলহীন কাঁকরের উপস্থিতি।


আর অনুপস্থিত পুরুষটির ছবির কাছে পড়ে থাকে মুঠো মুঠো নীরবতা, বৃষ্টিবিন্দুবিহীন বন্ধ্যা মেঘ। উপদ্রুত শব্দটি খুব এক অব্যর্থ প্রয়োগ। যা শান্তি ও স্বস্তি এনে দেয় না, কেবল মিথ্যে প্রত্যাশা ও বিভ্রান্তি জাগায়।


নিষ্ফলা মেঘের বিপ্রতীপে এবার উঠে এল কালিদাসের মেঘদূতের সেই ফলবান পুষ্কর মেঘের মিথ। আষাঢ়ের প্রথম দিনের সেই উথাল পাথাল বিরহের ইশারা আমাদের জানিয়ে দেয়, ঘৃণা নয়, অপ্রেম নয়, শেষ পর্যন্ত শাশ্বতীর কবিতার মূল সুর প্রেমই। তবে সে প্রেম নিরঙ্কুশ নয়। তার প্রিয় পুরুষও যেন এক আশ্চর্য বিষবৃক্ষ।  তাকে ভুলে থাকা দুষ্কর,  কাছে টেনে নেওয়া আরও দুরূহ।


মনে পড়ছে শাশ্বতীর 'পিরানহা' নামের ভয়ংকরভাবে খ্যাত কবিতাটি নিয়ে জয় গোস্বামী লিখেছিলেন পিরানহার কামড়ে মেয়েটির মাংসে রয়ে গেছে ক্ষতচিহ্ন কিন্তু  মর্মে সুরক্ষিত আছে স্মৃতিময় প্রেম।


এই দুরতিক্রম্য মানসিক দ্বিধা ও সংশয়ে শেষ হয়েছে এই কবিতাটিও : " অদূরে মেটিং কল বেজে যায়,  ব্যর্থ বেজে যায়... "


এসব কবিতা পাঠ করে পাঠক হিসেবে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ভালোলাগা আর বিষাদ দুই শব্দহীন বান্ধব পাশাপাশি হেঁটে যায় মনের ভিতরে এক অচেনা পথ ধরে।


             * কৃতজ্ঞতা স্বীকার - কবি অধ্যাপক উত্তম দত্ত