এই আসরে আমার একটি কবিতা পড়ে  জনৈক কবি-পাঠক  'অশ্লীল'  বলে মন্তব্য করে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যদিও আমি ব্যাখ্যা দেওয়ার পর তিনি ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আমার সমর্থনে অপর একজন কবি-পাঠক মন্তব্য করেছিলেন, এই কবিতাকে যদি উনি  অশ্লীল বলেন, তাহলে বিনয় মজুমদারের কবিতাকে উনি কী বলবেন?
       হ্যাঁ, কবি বিনয় মজুমদার তাঁর বহু কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতাকে এক আশ্চর্য সুন্দর শৈল্পিক রূপ দান করেছিলেন। তবে তাঁর যে গুণটি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে তা হলো প্রেমের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা।
       সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্ভবত সকল তরুণীর মধ্যেই নীরাকে খু্ঁজে  পেতেন, কিন্তু বিনয় মজুমদার জনৈকা গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই নিষ্ঠা ভরে ভালবেসে গেলেন, যে কারণে বিয়েই করলেন না সারা জীবন। ডায়রির আকারে লেখা কবিতাগুচ্ছে সেই চক্রবর্তীই 'চাকা' হয়ে ফিরে এলো কাব্যরসিক বাঙালীর ঘরে ঘরে। বাঙালী পাঠক পেয়ে গেলেন অপূর্ব এক ভিন্ন আঙ্গিকের স্বাদ। জনপ্রিয়তায় দিগগজ কবিদেরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিলেন।
        অবিভক্ত বাঙ্গলার কুলতলি ও ফরিদ পুরে তাঁর শৈশব কাটলেও ১৯৫৩ সাল থেকে বাবা-মায়ের সাথে পাপাকিভাবে বাস করতেন উঃ ২৪ পরগণার বনগাঁ-ঠাকুর নগরে।বরাবর উচ্চ মেধাবী এই মানুষটি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আই এস সি পাশ করার পর শিবপুর বি ই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং হয়ে বিভিন্ন উচ্চ পদে কর্ম জীবন কাটিয়েছেন। অবশেষে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১১ই ডিসেম্বর, ২০০৬ সালে পৃথিবী  ছেড়ে চলে গেলেন, আর তাঁর আরাধ্যা 'চাকা'কে অমর করে রেখে গেলেন কাব্যরসিক মানুষের হৃদয়ে।
           আমার প্রতিবেশী এক কবি প্রায়ই যেতেন অসুস্থ কবিকে দেখতে।তাঁর কাছে শুনেছি, অনেকেই নাকি বিনয়বাবুর কাছে কবিতা লেখা শিখতে আসতেন। যদিও আমি জানি না কবিতা লেখা কারো কাছে শেখা যায় কি না!
           যাই হোক, তাঁর 'ফিরে এসো চাকা' কাব্যগ্রন্থ থেকে এখানে একটি কবিতা তুলে দিলামঃ-


২৬ অগাস্ট, ১৯৬০
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে।
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মতো কণা কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায়, শোনো,কী অস্ফুট স্বরে, শোনো
'কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা,শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, এ কি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না অস্বচ্ছ মৃত্তিকাপূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে,
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো, অবহিত হও।


সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল,
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশে
সঞ্চারিত হতে চাই, চিরকাল হতে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভাল লাগে বলে,
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।
                   -------------
    
      




,