বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত মিছিলের সমান বয়সী কবি, কবিতার সাধক কবি কামাল চৌধুরী অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থ হলো- ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা’।  বইটির নাম এবং প্রচ্ছদ দেশপ্রেমী যে কারো  মন আকর্ষণ করবে। আমিও ‘নাম এবং প্রচ্ছদ’  দেখেই প্রথম প্রেমে পড়ি বইটির। এরপর এক একটি কবিতা পড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে বইটির প্রতি আমার ভালোবাসা এবং হৃদয়ে জন্মে যায় কবির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ। অনুভব করি বইটির প্রতি এবং কবি'র প্রতি ভিন্নরকম একটি টান- শিশুরা যেমন অনুকরণীয় কোন অগ্রজ খুঁজে পেলে তার সাথে স্বভাবসুলভ মিশে যাবার প্রবণতা প্রকাশ করে ঠিক তেমন! মূলত সে কারণেই ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা’ বইটি নিয়ে একজন পাঠক হিসেবে বইটির কারণে সৃষ্ট  অনুভূতি তুলে ধরতে ইচ্ছে হলো একান্তই ভালোবাসায়। তাই এই লেখাটিকে হয়তো 'বুক রিভিউ বা সাহিত্য সমালোচনা' হিসেবে নিয়মের ছাঁচে ফেলা যাবে না, বরং বইটি পাঠের অনুভূতি হিসেবে মনে করা শ্রেয় হবে।


প্রথমেই বইটির ভূমিকা পাতাটিতে একটু দৃষ্টি নিবন্দিত করে দেখা যাক। বইটির ভূমিকা পাতায় বেশ নন্দিত ভাষায় বলা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার অসামান্য ও বলিষ্ঠ রূপকার এই কবির কবিতা ধারণ করে আছে রক্তাক্ত মানচিত্রের শোক ও গৌরবগাথা, যেখানে মুক্তি ও স্বাধীনতার শাশ্বত উপলব্ধি নদীর স্রোতের মতো বহমান।” এরপর উৎসর্গ পাতা।বাঙালির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরম শ্রদ্ধায় বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে। এটি বইটিকে আরও অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে কারণ এই মহান রাজনৈতিক কবিই আমাদেরকে মুক্তির কবিতা, স্বাধীনতার কবিতার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন; সংগ্রামে এবং যুদ্ধে বিজয় এনে দিয়েছেন। তাই উৎসর্গ পাতাটির অক্ষরগুলো সোনার হরফে লেখা বললে অত্যুক্তি করা হবে না।


তারপর, শুরু হয় কবিতা পাঠের স্বাদ নেয়া!  প্রত্যেক কবির কবি জনমের একটি প্রার্থনা থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রার্থনা করেছিলেন – “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।” দেশপ্রেমিক কবি কামাল চৌধুরী তার এই বইয়ের প্রথম কবিতাটি ‘জন্মের প্রার্থনা’; যেখানে কবি তার জন্মের স্বার্থকতা খুঁজেছেন মাটি, মানুষের ভালোবাসার মাঝে । প্রার্থনায় নিমগ্ন কবি বলেছেন,


” মুক্তিযোদ্ধারা যদি মৃত্যু ও বারুদের ঘ্রাণে
ভালোবাসে আমার কবিতা
আমি সেদিন বলবো
সমস্ত প্রার্থনা আজ শেষ হয়েছে
জন্মের ঋণ আমি স্বীকার করেছি ।”


কবি প্রার্থণা শেষ করে, ঐসব ব্যক্তির জন্মদিনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন করেছেন যেসব ব্যক্তি দেশের কথা, মানুষের কথা, প্রকৃতির কথা, কবিতার কথা বলেন।  তাদের স্তুতি গেয়েছেন দ্বিতীয় কবিতায় – ‘জন্মদিনের কবিতা’। এই কবিতায় কবি পূর্বোক্ত এমন ব্যক্তির জন্মদিনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাদের জন্মের নামে পতাকা ওড়াবেন ভালোবেসে। অনাধিকাল ধরে  সুন্দরতম পথে ডাকার আহ্বান জানানো হয়েছে এই কবিতায়। ‘মুক্তি ও বিপ্লবের কবিতা’ অসাধারণ একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা । হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবিতাটিতে যুদ্ধকালীন সময়ের প্রজন্মকে দারুনভাবে চিত্রায়িত করেছেন। কবি বলেছেন,
“যারা জন্ম নিলো আমরা তাদের নাম রাখলাম বিপ্লব,
যারা জন্ম নিলো আমরা তাদের নাম রাখলাম মুক্তি । ”


মুক্তিযোদ্ধার জয়গান গেয়েছেন কবি সুমধুর কন্ঠে দ্বিধাহীন চিত্তে । এইগ্রন্থের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে বহুমাত্রিক দ্যোতনায়। মুক্তিযোদ্ধা কবিতায় কবি সম্মানিত এই বীর সন্তানদের বলেছেন, ” পতাকার নিচে তোমরাই গ্রহ-তারা ।” ‘একাত্তর’ কবিতায় বাংলার বীর সন্তানরূপে কবি দামাল ছেলে সেজেছেন। বলেছেন,“আমরা তাড়াতে পারি হন্তারক, দস্যু হানাদার ।” মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসীম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী কবি তাই বলে বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধাদের ছেড়ে কথা বলেননি। ‘সকলেই যোদ্ধা নয়’ কবিতায় এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, “তারা সবাই যোদ্ধা নয়, চেতনা-বাহকও নয়!” চেতনা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই কবিতাটিকে বেশ সাহসী উক্তিই বলা যায়।


জাতির জনকের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা কবি কামাল চৌধুরীর। কবিতায় বঙ্গবন্ধুর বন্দনা করেছেন হৃদয় উজার করে। “সেই মুখখানি কবিতার বড় ছিলো” কবিতায় যে মুখখানির কথা বলেছেন তা আমাদের জাতির জনকের মুখখানি। জনকের হত্যাকাণ্ড এদেশের কপালে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছিলো। কবি এটি মানতে পারেননি। বারবার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ কবিতায় বাংলাদেশের সব গ্রামগুলোকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন জাতির জনকের আদর্শের। দশ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়েও একটি কবিতা আছে কবিতাগ্রন্থটিতে। বলা যায় বইটি জাতির জনককে উৎসর্গ করা সেরা আদর্শলিপি।


আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের মাধ্যমে, রক্তদানের মাধ্যমে কবিতার ভাষা কেনা হয়েছিলো। দেশপ্রেমিক এই কবি তার মুক্তি ও স্বাধীনতার পদাবলী লিখতে গিয়ে অমর একুশকে তুলে ধরেছেন যথাযথভাবে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’,  ‘অভয় মিনার’ কবিতা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাথে সাথে কবি সংগ্রামী মার্চের গান গেয়েছেন  ‘মার্চ’ কবিতায়, বিজয়ের ফানুস উড়িয়েছেন ‘বিজয় দিবস’ কবিতায়।


বইটিতে কবি স্মরণ করেছেন কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিকে, যাদের কাছে এই জাতি মুক্তির গান, স্বাধীনতার পদাবলী, রাজাকারদের বিচারের দাবি শুনেছেন। মহান সেই ব্যক্তিরা হলেন- শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, হাসান হাফিজুর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, কবি সুফিয়া কামাল। এছাড়া  ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা’ বইটিতে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা, অধিকারের কথা বলেছেন দুর্দান্ত লেখনির মাধ্যমে। অধিকারহারার আর্তনাদও আছে কবিতায়। যেমন
“বাতাসে কান্নার শব্দ, আর্তনাদ, অশ্রু হাহাকার/
জাগরণে রাত্রিকালে/
সভ্যতার মৃত্যু বুঝি দেখে নিচ্ছে সন্তান তোমার! “


পরিশেষে বলতে চাই, ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনার ধারক । যেকোন পাঠক  তার বইটি পড়ে একরাশ মুগ্ধতা খুঁজে পাবেন । সবার জন্য পাঠযোগ্য বইটিতে নেই কোন দূর্বোধ্য শব্দ চয়ন, অনন্য রচনাশৈলী এবং বইয়ের নামকরনের সাথে যথাযথ সঙ্গতিপূর্ণ কবিতার সমাহার রয়েছে বইটিতে। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে, সমৃদ্ধ  কবিতার জগতে এটি একটি অন্যন্য সংযোজন ।যুগ যুগ ধরে পাঠকের মনে পাকাপোক্ত ভালোবাসার জায়গা করে নিবে বইটি এবং সর্বসাধারণের জন্য বইটি প্রেরণা হয়ে থাকবে, কবির লেখা এই লাইনের মতো কবির চাওয়া অনুসারেই- ‘আমরা হারিনি। এই দৃশ্য  বিজয়ী জাতির।’