১.
আমি কেন জন্মাইছি, তা আমি আজও জানতে পারি নাই। দুনিয়ার প্রতিটা প্রাণীর মতো আমিও জন্মাইছি মাতৃগর্ভের অন্ধকারে! ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে আমি বাইরের পৃথিবীতে প্রথমেই কি অন্ধকার দেখিছিলাম? তা আজ আর আমার মায়েরও স্মরণে নাই।


জীবনভর পৃথিবীর বাতাসে আমি জীবিত থাকার মতো হয়তো যথেষ্ট অক্সিজেন পেয়েছি!  কিন্তু বেঁচে থাকার মতো একটু অক্সিজেনও আমি পেয়েছি কিনা, আমি জানি না।
ইদানিং আমার মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে! অন্ধকার বিছানায় বিষাদগ্রস্ত ক্লান্তিতে জেগে থাকি! পৃথিবীতে শুধু একটা মানুষই এই ক্লান্তি টের পায়– তিনি আমার আম্মা!


ওনার এই ক্লান্তি দূর করবার ক্ষমতা আজ আর নেই, তাই উনিও নিরুপায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন! আমি মুখ ফিরিয়ে নিলে উনি আঁচলে মুখ মোচেন! ইদানিং ওনার কান্না দেখলে আমার চোখ হতে আর অশ্রু গড়ায় না! আমার চোখে আগুন জ্বলে উঠে!  এই আগুন যে পৃথিবীর সবচেয়ে হিমশীতল আগুন, তা আমি না বুঝলেও আম্মা ঠিকই বুঝেন। এই আগুন এতটাই অক্ষম যে, এই আগুনে আম্মা হাত রাখলে চোখ দুটি হয়ে যায় অবিরাম ঝর্ণাধারা!


ছোটবেলায় আম্মাই তো আমার কল্পনায় একটা স্বর্গের আল্পনা এঁকেছিলেন! সেই স্বর্গে আমি কেন তোমাকেই পেতে চেয়েছি, হে আমার ব্যর্থ প্রেমের প্রথম এবং প্রধান প্রতিনিধি!
ভালোবেসে মনে মনে গোপনেও তো আমি তোমাকে চাইতে পারতাম! কিন্তু আমি তোমাকে চেয়েছি প্রকাশ্যে। তুমি অন্যের বধূ বলেই কি তুমি আমার বন্ধু হয়ে থাকতে চেয়েছিলে শুধু? নাকি শরীরে সোনার গয়নার মতো তুমি মস্তিষ্কেও জড়িয়ে নিছো সামাজিক শেকল! যে সমাজ সকালে তুমি মারা গেলে বিকালে মাটির আবরণে ঢেকে তোমার লাশ পদতলে পিষ্ট করতে করতে তোমার মৃত চোখে অবশিষ্ট আলোটুকুও কেড়ে নেয়, তুমি সেই সমাজের ভয়ে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে? যে সমাজ আমি নামাজ পড়তে গেলেও সন্দেহের চোখে দেখে, আমি সেই সমাজ কোনোকালেই গুনি নাই!
জাহাঙ্গীরনগরের চিরসবুজ ক্যাম্পাসে আমি কবি হইতে যাই নাই, কবিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমি ওখানে ৪ বছর সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতিটাই করতে চেয়েছি । অথচ রাজপথে পাশাপাশি হাঁটার মুহূর্তে আমার কমরেডরা আমাকে সন্দেহই করেছে শুধু! তবুও আমি স্লোগান দিয়েছি, 'কেউ খাবে, কেউ খাবে না,  তা হবে না, তা হবে না!' অন্তরে ঠিকই তোমার মুখচ্ছবিটা ফুটে উঠেছিল! হৃদয়ে যে কণ্ঠস্বর থাকে, তা থেকে উচ্চারিত হয়েছিল–'কেউ পাবে, কেউ পাবে না– তা হবে না, তা হবে না!' আমি তো তোমাকে সত্যিই পাই নি, চন্দ্রিমা!  তুমি কি জানো, আজ পর্যন্ত আমি কাউকেই পাই নি! একযুগ পার হল– তোমাকে ভালোবেসেছিলাম! ভালোবাসতে ভালোবাসতে হয়তো আমার এক জনম কাটবে, অবশেষে একদিন কি তুমি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে?


না, আমার আর কোনো প্রতীক্ষা নেই!  কারুর জন্যই আজ আর প্রতীক্ষা নেই! না জীবনের জন্য, না মরণের জন্য। না আমার জন্য,  না তোমার জন্য। অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে আমার দৃষ্টিতে বয়ে গেল এক সমুদ্র নোনাজল! না, সেই জলের উপর আজও আমি দেখি নি কোনো হংসী। সেই সমুদ্রপারে আজ আর কেউ বাজায় না বিরহের বংশী! অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে আজ আমি নিজেই ভেঙে গেছি, চন্দ্রিমা!


তোমার কি মনে পড়ে? সন্ধ্যারাতের চাঁদের আলোয় ফোনকলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তোমার চোখে নামতো অমবস্যার ঘোরতর অন্ধকার! শরতের রাতের আকাশে তুমি জ্বলছিলে অন্য কারুর আকাশের চাঁদ হয়ে! আমার নিজস্ব আকাশ ছিল না সেদিন, তাই মাটির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে দু'হাত বাড়িয়ে আমি শুধু দুমোঠো জ্যোৎস্না ভিক্ষা চেয়েছিলাম! একটা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট অথবা বুকে একটা পকেট না থাকার জন্য তুমি জ্যোৎস্নার পরিবর্তে দিলে একমুঠো বৃষ্টি! তবুও আমি আমার প্রেম ভাসিয়ে দিই নি কাঁদাজলে! চাঁদপুরে লঞ্চে দাঁড়িয়ে তোমাকে মনে পড়ে যাবার ভয়ে আমি রাতের আকাশের দিকে আজও তাকাই না। শুধু নদীজলে দেখি চাঁদের প্রতিবিম্ব! আমি তো কোনো নবি নই, আমি জানি না কোনো বিশেষ মোজেজা!  তবে তুমি কার নির্দেশে আজ ত্রিখণ্ডিত হলে! আমিও তো তখন পর্যন্ত তোমার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। সেই ঈশ্বর তো আমাকে প্রেমিক-পুরুষ হিসাবেই প্রতিদিন নব নব রূপে সৃষ্টি করছিল? তবে কোন ঈশ্বরের ইশারায় তুমি  মা হতে জাপান চলে গেলে? টোকিও বিমানবন্দরে নেমে তোমার কি একবারও আমার কথা মনে পড়ে নাই?
কবির কল্পিত আকাশের চন্দ্র নয়, তুমি চিরকালই 'মা' হতে চাইছো, চন্দ্রিমা! এটা বুঝার পর তোমাকে নিয়ে লিখা কবিতাভর্তি ডায়েরিটা ঘরের পাশের নোংরা ডোবায় ফেলে দিয়েছি। তোমাকে উপহার দিব বলে কাঞ্চনপুর দরগার শরীফ ওরস থেকে আমি যে মাটির পুতুলটা কিনেছিলাম, পিঠব্যাগে সেটি নিয়ে আমি পথে পথে অলিতে গলিতে অগণিত ঘুরে বেড়িয়েছি! যেদিন আমি জানতে পারলাম, তোমার পুতুলের মত একটা মেয়ে হয়েছে, আমি চারতলা থেকে সেই 'মাটির পুতুল' ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি কংক্রিটের পৃথিবীতে!


চন্দ্রিমা, চাঁদের সাথে তোমার উপমা যায় না। কারণ আজ আমি জানি, কোনোদিনই তোমার নিজস্ব কোনো আকাশ ছিল না!  আজও নেই! ফুলের পরিবর্তে তুমি চিরদিনই ভালোবেসেছো সোনার দুল! অপ্রিয় হলেও সত্য, ঘনচুলের লম্বা চুলের কিশোর কবির পরিবর্তে তুমি যে-কোনো নারীর মতন বেছে নিলে দামী মুকুট পরা টাক মাথার টাকাওয়ালা বর! চন্দ্রিমা, তোমার পারভাঙা নদীর ওপারে আজও জাগে নাই চর! জীবনে আরও নারী এলেও আজও আমার গড়ে উঠে নাই একটা একান্ত ব্যক্তিগত  ঘর! চন্দ্রিমা, তুমি ফুলও নও, ভুলও নও। তুমি একটা 'মাটির পুতুল'। তোমাকে ব্যক্তিগত বিছানায় নেওয়ার ইচ্ছা আমার কোনো কালই ছিল না!  আর কে না জানে, সুগারড্যাডিরা যাদেরকে ব্যক্তিগত বিছানায় নিয়ে ব্যবহার করে ছেড়ে দেয়, কবিরাই তাদের মনের বেদিতে রেখে 'দেবী' হিসাবে পূজা করে! কিছুদিনের জন্যে হলেও তাদের অমর করে রাখে অক্ষরের জাদুতে!  আমি তোমাকে অমর করতে আসে নি, মারতেও আসে নি!  আমি তোমার জীবনে শুধু এসেছিলাম তোমাকে মুক্ত করতে। আমি আজও চাই, তুমি সোনার শিকলগুলো খুলে ফেলো আমার কবিতা পড়তে পড়তে!


তুমি বলেছিলে, 'আর কেউ না পড়লেও আমি তোমার কবিতা পড়ব।' হৃদয়ের অন্দর ভেঙে তুমি টোকিও বিমান-বন্দরে উড়াল মারার পর আজ পর্যন্ত আমি প্রায় দেড়শ কবিতা লিখিছি, তুমি যে তারপর দেড়টা কবিতাও পড়ো নাই!  তা আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। শুধু তুমি কেন? বাংলাসাহিত্যে সম্ভবত আমার কবিতার পাঠক দেড় ডজনও হবে না। তবু কেন যে লিখি এসব ছাইপাঁশ, জানি না! হয়তো কোনো একদিন তোমার পুতুলের মতো মেয়েটি পড়বে বলেই । তোমার মেয়ে যদি বাংলাভাষা রপ্ত করতে না পারে,  যদি জাপানে তোমার মৃত্যুর আগে তৃতীয়বারের মতন পারমাণবিক বোমাবর্ষণও হয়, আমি জানি তবুও তোমার চিরনিদ্রায় শায়িত হবার মুহূর্তে ঠিকই তোমার কানে বেজে উঠবে আমার লেখা কবিতার শেষ লাইন!


নিজের প্রিয়তমার পাশবালিশে যে মহৎ পুরুষই শুয়ে থাক! সে হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে পাশবিক শত্রু! বার্ট্রান্ড রাসেলের 'ম্যারিজ এন্ড মোর‍্যালস' পড়বার আগেই আমি তা জেনে গেছি! সেই দিনগুলোতে আমার যে কী যন্ত্রণা হত, তার সিকিভাগও কি তুমি অনুভব করেছিলে, চন্দ্রিমা?


আমি জানি, আজ আর তুমি কারুরই বধূ নও, কারুর বন্ধুও নও, নও কবির কল্পিত স্বর্গসঙ্গী কিংবা প্রিয়তমা, আজ তুমি শুধুই মা! জেনে রেখো, আজও এই ব্যথিত আত্মা করি নি তোমাকে ক্ষমা। নিজের সতীত্ব রক্ষার ছলে তুমিই তো আমাকে দিয়েছিলে কবিত্ব!


আমি শুনেছি, তোমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর টোকিও। অথচ আমার আজও মনতলা বাজারে গেলে তোমার কথা মনে পড়ে। 'চাঁদপুর' বলতে আজও আমি তোমাকেই বুঝি, চন্দ্রিমা! চাঁদপুরের হাওয়া বুকে লাগলে আমার খুব ধূমপান করতে ইচ্ছে করে!


তুমি কি জানো, নদীর জলে চাঁদের প্রতিমা দেখতে দেখতে, তোমার প্রতারিত প্রতিমূর্তি দেখতে দেখতে আমি একদিন নদীটাকেই ভালোবাসতে শুরু করেছি। লঞ্চ মেঘনা পার হয়ে গেলে নদীর পরিবর্তে আমি দেখি একটা প্রশস্ত অন্তহীন জলপথ!