আমার ভেতরে একজন ব্যর্থ বিপ্লবী
অনেক অনেক দিন আগে আত্মহত্যা করেছিল—
আমি সেই আত্মহত্যাকারীর ব্যর্থ মৃত অতৃপ্ত
আত্মা শরীরে বয়ে নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিলে
সমাবেশে নৈরাশ্যের নেশাচক্রে
তবুও ফেরি করেছিলাম কিছু লাল স্বপ্ন
আরও কিছুদিন!


যদিও জেনেছিলাম, আমি রবো চিরদিন
তোমার অপেক্ষায় প্রেমহীন— বৃষ্টিহীন;
তবুও অন্ধ নিঃস্ব ভিখারীর মতন হাত পেতেছিলাম;
আজ অবধি তুমি ছাড়া কেউ তো আমারে
ডাকে নি একান্ত মুহূর্ত কাটাবে বলে
কোনো গোপন অভিসারে!
আমার আধো ঘুমের ভেতরে কে যেন  নাম ধরে
ডাকে বারে বারে—  সে কি তুমি? নাকি ঘোরের ভেতরে
জাগ্রত স্বপ্নের ডালে ঘুর ঘুর করা কোনো ডাহুক?
নাকি ভয়ানক সব দুঃস্বপ্নের চাদরে মোড়া সেই অসুখ?


জেনে রেখো, প্রিয়কণ্ঠী প্রিয়তমা আমার
আমি ভালোবাসতে পারি না আর তোমারে!
আমি ভালোবাসতে পারি না আর আমারে!
আমি ভালোবাসতে পারি না এমনকি, তারে!


যে নারী পাখির রূপ ধারণ করে সারা আকাশজুড়ে চরে
আমার চারদেয়ালের নিঃসঙ্গ ইটের ঘরে
চেয়েছিল একটা একান্ত নিজস্ব নিরাপদ আশ্রয়!
আগুনে পুড়ে পুড়ে যার কৃষ্ণ পালক হয়েছিল স্বর্ণময়!
আমি নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করি আমারে—
আঁখিতে আগুন মেখে তুমি কি সত্যিই ভালোবেসেছিলে
কিংবা একান্ত নিজের করে পেতে চেয়েছিলে তারে?
আমি জানি না!


আমি জানি না, তোমার আঁখিতে  
যে মেঘগুচ্ছ জমে আছে
তা আজ কার বিরহের তরে
তুমুল বৃষ্টি হয়ে ঝরে?
কার বাগিছায় সে বৃষ্টিজল ফুলে ফুলে
ব্যাপক বিপুল রোমাঞ্চ ছড়ায়?
বৃষ্টির দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা সেই জলকণা
মুক্তোর মতন ঝলমলিয়ে ফুটে আছে
কার ভালোবাসার ঘাসে?
আমি জানি না, তুমি 'চাঁদ' হয়ে জ্বলো আজ
কার আকাশে, কার বাতাসে তুমি ডানা মেলে ভাসো?
আমি আজ আর জানি না, তুমি কারে
ভালোবাসো?
আমার আর ভাল্লাগে না, সত্যি সত্যিই
আমি আর ভাবতে চাই না তোমারে !


তোমার হাত ছুঁয়ে পথ চলতে আমার আর ইচ্ছে হয় না
যার আকাশে খুশি উড়ে যেতে পারো
হে আমার হৃদয়ের নীড়ে অনবরত
ডাকাডাকিতে অস্থির ছটফটরত প্রাণপাখি ময়না—
তোমার কানে ক্রমাগত একটা অপ্রিয় গান বারবার
অবিরাম বেজে চলার মতন
বিরক্তি আর ক্লান্তিকর ডাকাডাকি
আমার প্রাণে আর সয় না!
তোমাকে ভালোবাসতে আমার ইচ্ছে হয় না, পাখি!
শুধু তুমি না, পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট একক
কাউকে কোনোকিছুকেই আমার আর
এক মুহূর্তের জন্য সহ্য হয় না—
যদিও আমি আজও বড় নিঃসঙ্গ এবং একাকী!


আমার শুধু সন্দেহ হয়, তুমি কি সত্যিই আমার নয়?
আমার শুধু সন্দেহ জাগে, শাহবাগে
যারা দু'চারটা প্ল্যাকার্ড পোস্টার হাতে চিৎকারে চিৎকারে
আকাশ ফাটায়, শোষিত লাঞ্চিত বঞ্চিত নিপীড়িত
মানুষের অন্তরে কি তাদের আওয়াজ আদৌ পৌঁছায়?
তারা কি দাসত্বের কারাগার অর্থাৎ
ব্যক্তিমালিকানাধীন সমস্ত সম্পদ আর সম্পত্তির
চিরতরে উচ্ছেদ চায়? তারা কি ফুলে ফুলে
প্রজাপতিদের অবাধ বিচরণে আস্থা রাখে?  
জীবনের বাঁকে বাঁকে যতসব স্বপ্ন ঝরা-পাতার মতন
পড়ে আছে, স্বার্থপর বিষধর নগরের ফুটপাতে
যত নগ্ন রুগ্ন মৃত অর্ধমৃত অসহায় প্রাণ পড়ে আছে—
তারা কি সবার একটা থাকার মতন নিরাপদ বাসস্থান
বাঁচার মতন একটা নির্ভাবনার জীবন
কিংবা মৃতের 'চিহ্ন' হিসাবে একটা নির্দিষ্ট গোরস্থান
অথবা শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের জন্য প্রস্থান
তারা সত্যিকার অর্থেই চায়?
তারা কি সমাজতন্ত্রের জলোচ্ছ্বাস জাগাতে চায়
ধনতান্ত্রিক দূষিত সামদ্রিক তটে?
আমার কেবলই সন্দেহের উদ্রেক ঘটে!


তবু আমি মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা ধারণ করে
অদৃশ্য অস্তিত্বহীনতায় মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে
বিপ্লবের অলীক স্বপ্নের ব্যারামে তাদের সাথে
হাতে হাত রেখে রাজপথে দাঁড়িয়ে যাই;
আজও মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষে লাল নীল
স্পন্দনে জ্বলছে ভাঙচূরের নেশা;
নিঃশব্দ জনহীন জঙ্গলে তোমার আলিঙ্গন
এবং চুম্বন পেতে ইচ্ছে হলেও আমি ইদানীং
খুব খুব ভয় পাই বিষধর সর্পদংশন!
তোমাকে চিরিতরে হারিয়ে ফেলার আশংকা বুকে চেপে
আমি পুনর্বার মিশে যেতে চাই বারুদগ্ধ অগ্নিময়ী
স্লোগানে ছত্রভঙ্গ পিকিটিং-এ,  রাজকীয় চেয়ারে
বসে রাজসভার 'ক্রীতদাস' হওয়ার বাসনাটা
মূলত জেগেছিল তোমাকে, হে আমার চিরপ্রেমিকা
জীবনের বন্ধনে আবদ্ধ জীবনসঙ্গিনী, হরিণী
আঁখিবিশিষ্ট রমণী, আমার প্রিয়তমা সহধর্মিণী—
তোমাকে, শুধু তোমাকে পাবার আকাঙ্ক্ষায়!  
আজ আর তোমাকে পেতেও আমার ইচ্ছা হয় না;
আজ আর ছুঁতে ইচ্ছে করে না তোমার অতিসুন্দর থুতনি
ছুঁতে ইচ্ছে করে না তোমার চিবুকের ছোট্ট তিলটি
আজ আর আমার দিতে ইচ্ছে করে না আমার গভীরে
টগবগিয়ে ছুটে চলা দুরন্ত প্লবগ প্রেম!
তোমার জন্যে আমার দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না
তোমার অপক্ষাতে ওয়েটিংরুম লাগে খুব বোরিং
তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করলে হয়ে যায় ব্যাপক স্মোকিং
তোমাকে স্বপ্নে দেখার ভয়ে আজ আর আমার
ঘুমাতেও ইচ্ছে করে না!


রাজপ্রসাদের সমস্ত রাজকীয় চেয়ারের স্বপ্নে লাথি মেরে
আমি সর্বহারাদের গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চাই
পারমাণবিক যুদ্ধের প্রাকমুহূর্তে আমি আমার
সেই প্রেমিকাকে ফেরত চাই, যে স্বেচ্ছায় টেনে নিয়েছিল
আমার বেদনাবিদ্ধ বিরহদগ্ধ কান্নাসিক্ত হাত
তার হাতের অনামিকায় কোনো পরপুরুষের দেয়া
সোনার আংটি ছিল কিনা, আমি মনে করতে পারছি না পরপুরুষের স্ত্রীকে ভালোবাসা পরকীয়া কিনা, আমি
তাও জানতে চাচ্ছি না, আমি শুধু জানি—
সে চেয়েছিল আমাকে
তীব্রতম তৃষ্ণার্ত দিনগুলিতে, আমি শুধু জানি
তীব্র ভালোবাসা সত্ত্বেও আমি তাকে চাই নি নিতে
আমার অতিব্যক্তিগত একান্ত বিছানাতে
শুধু চেয়েছিলাম যে-কোনো রাস্তায় অথবা ফুটপাথে
একবার, শুধু আর একটিবার
আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে যাক;
সে অচেনার মত হনহনিয়ে চলে গেলেও
আমাকে সে চুপচাপ আড়চোখে দেখে নিয়ে
কিছু না বলে অপেক্ষার শেষ ট্রেনে উঠে গেলেও
আমি শুধু তাকে ফের তীব্রভাবে দেখতে চাই—
তাকে পুনর্বার দেখার আগে আমার চোখের আলো
চিরতরে নিভে গেলে— আমার অতৃপ্ত আত্মা
পৃথিবীর সর্ববিনাশী মুহূর্তে তার চিরচেনা
মুখচ্ছবির দিকে রবে তাকিয়ে!


আমার আর কতবার মনে হবে, সত্যিই
আমি বেঁচে নেই! আর কতবার মনে হবে—
আমার চতুর্পাশে পাহারা দিচ্ছে একঝাঁক শকুন
আমি মরে গলে, পঁচে গেলে ওরা খুবলে খাবে
আমার শরীর, যে শরীর তোমাকে 'কবুল'
বলার পরও পায় নি চরমতম সুখ!
যে শরীরে আজও ভালোবেসে কেউ
ছিটাই নি দু-একটা বকুল!
যে শরীর আলিঙ্গন চাইতে প্রিয়তমার কাছে
পেয়েছে কেবলই অবজ্ঞা, যে শরীর
কদিন পর মিশে যাবে মৃত্তিকার সাথে
পোঁকামাকড় খেয়ে যাবে কিছুদিন পর
তোমার আমার পরস্পরের স্পর্শগুলি, আর অন্তহীন
ভালোবাসাবাসি!


আমার বারংবার মনে হয়, তুমি আমার নও
আমি আর কোনোদিনও চাই না, তুমি আমার হও
যে প্রাণ ছুঁয়ে বলেছিল, 'ভালোবাসি'— সে কি তুমি নও?
নাকি তোমার মতন দেখতে অন্য কেউ?
নাকি বৃষ্টিস্রোতের ছদ্মবেশে ঝিকিমিকি রৌদ্রের ঢেউ?
আমার আবার মনে হয়—
আমি কি সত্যিই আছি আজো বেঁচে?
তুমি কি সত্যিই ছিলে একাকী নৈঃশব্দের ভেতর
একটা অপ্রকাশিত চিৎকার হয়ে?
অরণ্যের নীল অন্ধকারে ঝলমলে আলো হাতে
মোহনীয় ৩ জন রমণীর সাথে
আমার কি কিছু হয়েছিল কোনোদিনও?
তৃতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালীন পৃথিবীতে
পুনর্জন্ম হবে কি সমাজতন্ত্রের?
আমি কি আবার একটা উষ্ণ প্রেমময় আলিঙ্গন পাব?
মেঘে মেঘে জ্বলে ওঠার মতন বৈদ্যুতিক ভালোবাসা
পাব কি আমি কখনো প্রিয়তমা রমণীর সঙ্গমে?
আমি জানি না!


আমি মানি না, কবির ঠোঁটে চিরদিন
চুম্বনের বদলে শুধুই পুড়বে সিগারেট
আমি মানি না, প্রেমিকের মগজে কেবল বারুদ জমবে
অপ্রেমিকের টাকার ঝনঝনাতি প্রেমিকারা হেলে দুলে
পার্কে ঘুরবে, মদের বারে নেশার ঘোরে নাচবে
কাগুজে নোটের গন্ধ শুঁকে আমাদের প্রেমিকারা
শুয়ে পড়বে যার তার বিছানায়!
আমি মানি না, অন্ধরা প্রিয়তমার প্রিয়মুখ
কোনোদিনও আঁখির আলোয় দেখতে পাবে না!
আমি মানি না, নিঃস্ব মানুষ বিশ্বপ্রেমিক হতে পারবে না!
পরস্ত্রী কখনো কবির স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা হতে পারবে না— তা আমি মানি নি কখনো, মানি না আজও
মানব না কোনোদিনও !


আমি মানি না, প্রেম শুধু শারীরিক  
কিংবা ভালোবাসা শুধু মানসিক
আমি মানি না, মানবজন্ম ঐশ্বরিক
কিংবা শুধুই প্রাকৃতিক!
আমি মানি না, কোনো নারী কিংবা পুরুষ
কারুরই একান্ত ব্যক্তিগত
আমি মানি না, দুনিয়ার কেউ-ই হুবহু কারো মতো
আমি মানি না, পুরুষমাত্রই প্রেমিক
কিংবা সব অপরাধীই পাশবিক!
আমি মানি না, ভালোবাসার আগুনে
চিরতরে দাউ দাউ করবে কেউ!
আমি মানি না, ভালোবাসার ফাগুনে
নরনারীর হৃদসাগরের তীরে আচড়ে পড়বেই
চিরকালীন প্রশান্তিময় সুনীল ঢেউ!
আমি কখনো স্বীকার করি না, ফুলের বৃষ্টিতে
চিরকাল ধরে কেবল ভালোবাসার রৌদ্রই ঝরে!
আমি জানি না, কেন ভালোবেসে কোমল চন্দ্রমল্লিকা প্রিয়তমার কানে গুঁজে দিলে ফেরত পেতে হবে
বেদনার জ্বলন্ত উত্তপ্ত নীল শিক!


আমি শুধু জানি—
আমি কিছুটা পারিবারিক
বাকীটা অসামাজিক!
আমি স্বীকার করি—
আমি কিছুটা বৈপ্লবিক
বাকিটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক!
আমি মানি কিংবা না-মানি—
আমি কিছুটা সিজোফ্রেনিক
বাকীটা প্রেমিক!