যাত্রাপালায় হাতকড়া পড়া অবুঝ মেয়েটি
মেয়েটি নাটক করে , নাটকের মেয়ে ।
বিচারকের সামনে কাঠঘরায় দাঁড়িয়ে ,
ভেসে আসে ওপাশ থেকে , আস্তে বিচার চলছে এখন ।
উকিল উঠে এলো , গিতার বুক ছুঁয়ে শপথ পাঠ করলো
বিনোদিনী ।
এবার প্রশ্ন উত্তরের পালা কিন্তু তার জন্য কেউ নেই
তাই একজন আজ দুমুখো সেজে দাঁড়িয়ে ।
বিপক্ষের সওয়াল , আপনি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন
বিবাহের আগেই আর ওই সন্তান একজন ....
চুপ করুন , চিৎকার করে ওঠে বিনোদিনী
মানুষের সৃষ্টিকে যে অস্বিকার করে ,
তার পুরুষত্বকে আমি ঘেন্যা করি ।
যদি এ সন্তান আমার পাপ হয় , তবে আমি
আলবাত পাপি , কিন্তু একা নয় ।
হে পুরুষতন্ত্র , তোমরা কি দোষী নও বলো ?
বিপক্ষ আজ এই সুযোগ টুকুই খুঁজছিল ।
সে এগিয়ে এলো মেয়েটির দিকে ,
বললো মনে করিয়ে , সমাজের কিছু কথা ।
বিবাহের আগে তার সম্পর্কটা
একটি ভুল ।
তার অন্তঃসত্ত্বা রূপ একটি অপরাধ ।
এ সব ছলনা তার ।
নারীর এই স্বাধীনতা , হোক বহিস্কার --
ন স্ত্রী স্বতন্ত্রম আরহতি ।


কোর্টে ভিড় করা দর্শকদের মধ্যে থেকে
কিছু কথা ভেসে আসে কানে ।
কেউ বলে ঠিক বলেছে । কেউ বলে
সত্যিই আজকালকার মেয়েরা
পোশাক থেকে রুচি - সবক্ষেত্রেই অসূচিময়
দগদগে ঘা ; ঘাটা দগদগে তার ।
কাঠঘরায় বিনোদিনী চুপচাপ । তার চোখে জল ।
হাওয়ায় উড়ছে আঁচল ।
ভেসে আসে ওপাশ থেকে , আস্তে বিচার চলছে এখন ।


এ তো যাত্রা নয় , এ যাত্রা নয় আমার ; একটা অতীতকে
তুলে এনে মুখোস পড়ানোর উদ্দেশ্যে
সকলের চেষ্টা মাত্র ।
এ আমার বাস্তব ; বাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে নাটক করছি
তবে , এতদূর এগিয়ে গেছে যখন সব ,
তখন বলেই ফেলি ....
আমি তখন কলেজে । পড়াশুনায় সেরা ।
লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেটি
আমায় আকৃষ্ট করেছিল ।
হ্যাঁ , আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম ।
মর্যাদার রেখা ডিঙিয়ে তবু এগিয়ে যেতে পারিনি
কারন আমি একজন নারী ।
ছেলেটিরও বোধহয় ভাললেগেছিল আমায়
ক্যান্টিন , কমনরুম , মাঠ , ঘাট , ফিরে আসা পথে
তাকে বারবার দেখেছি আমি ।
নারীর স্বাধীনতা নেই দেখবার , নারীর হৃদয় হতে নেই
ভালোবাসবার -- এগুলো সমাজের চোখে অপরাধ হয় যদি
তবে , সেই ছেলেটির অপরাধ হবে না কেন ?
সেও তো একই দোষে দুষ্ট । এটা দ্বিচারিতা নয় ধর্মাবতার ?
তারপর ঘনিষ্ট হলাম দুজনে । মন মিশে গেল ,
শরীরটা ফাঁসানো হল একটা জালে ।
যেদিন আপনাদের ওই পাপটাকে পেটে ধরেছিলাম
সেদিন ছেলেটি ছিল না আমার পাশে
আমি সমাজকে বলেছিলাম , ওকে ধরে আনতে
এ পাপ আমার নয় , আমাদের ।
সমাজ কি বললো জানেন ?
জানি , ধর্মাবতার গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল
আমি জানি , সমাজ কি বলেছিল ;
আমি জানি , তোমার দ্বারা ভুল করে
একটা অপরাধ হয়ে গেছিল সেদিন
কিন্তু সংশোধন করতেই পারতে ! সন্তানটিকে
পৃথিবীতে আনার কি দরকার ছিল ?
সেটা না করে নিজের অপরাধকে স্বাধীনতার নাম দিয়ে
আড়াল করেছ তুমি ।
মনে রেখো , ন স্ত্রী স্বতন্ত্রম আরহতি ।


ধর্মাবতার , চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে বললো সে
ধর্মাবতার , একজন মা হয়ে হত্যার দায় কি করে নিতাম
বলুন ধর্মাবতার ।
বিপক্ষের মুখের হাসিতে স্পষ্ট , জয় হয়েছে তাদের
যাত্রাপালার এ খেলাঘরে , প্রমাণিত হয়েছে
তার অপরাধ । হেরে গেছে বিনোদিনী ।
হেরে গেছে এক স্বাধীন সমাজের কাছে ,
এক স্বাধীনচেতা মাতৃ সমাজ ।


আজ বিনোদিনীর চোখে মরুভূমি ।
বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে
ভিজছেন একজন মা , একজন স্ত্রী এবং একজন কন্যা ।