ডাক্তারের সবুজ সংকেত পেয়ে ঘরে ফিরেছিল মা,
তিন দিন আগে।
শারীরিক দুর্বলতা কিছু ছিল।
তবে,
তাতে বিপদের পূর্বাভাস ছিল না।
হাসপাতালের শেষ দিনে
এক ধরনের চকলেট
পুড়ে দিয়েছিলাম মায়ের মুখে।
বলেছিল,
“ভালই তো রে, খোকা;
আগে তো এমনটা খাই নি।”
বেশ ক’দিন দোড়াদোড়ি হল,
চাপা উৎকণ্ঠার মুহূর্তগুলি
কেটে গেলে সবেতেই যেন
লেগে যায় এক আলাদা ভাললাগার-পরত।
বেশী প্রিয় মনে হয় সবকিছুই।
বিপদের রেখা কেটে গেল।
কাছে থাকি,
বা দূরে;
ডুবে ছিলাম স্নেহ সাগরে।
সমস্ত কাজে ঢুকে পড়তঃ
মা ভাল থাকার কথাখানি।
পাখির কাকলির মত
কিলবিলানো আনন্দ
খেলে যেত সারা দেহ-মনে:
হয়ত মা শুয়ে,
হয়ত মেটে বারান্দায় বসে,
হয়ত টিভির সামনে,
হয়ত ভাত ভেঙ্গে মুখে দিচ্ছে,
হয়ত নাতিনী কোলে,
ফোরে পড়া নাতিটা সামনে বসে
গল্প গিলছে সন্ধ্যাবেলায়।
ভাললাগায় দেহ-মন মশগুল।


বিকেলে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিলাম,
জানালার সামনে মায়ের স্থির মুখ
সিঁড়ি দিয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে
মায়ের চোখের দৃষ্টি নামল আমাতে আটকে,
“খোকা, সেই চকোলেটগুলি ক’টা আনিস তো।“
আদরমাখা কথায় হাবুডুবু খেয়ে গেলাম।
“ঠিক আছে, তুমি ঘুমিয়ো না, মা”
রাতে ফিরছিলাম একটু তাড়াতাড়িই।
ডান পকেটে গোটা কয় সেই চকলেট।
হঠাত,
বাড়ি থেকে ফোন।
শশব্যাস্ত কিছু কথা এল ওপার থেকে,
"তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো
মায়ের অবস্থা ভাল নয়...”
আশেপাশের জমাট কিছু কথা মিশে হুড়মুড় করে ঢুকল কানে।
দেহে আমার রক্ত চলাচল কমে এল।
পা হয়ে এল ভারী,
মাথার মধ্যে ভীমরুলের ভোঁ ভোঁ।
মিনিট দুই কি তিন,
বাড়ি ফিরলাম।
পাড়ার লোকজন সদর দরজায় গিজগিজ,
নিজ থেকেই ভিড় সরে রাস্তা হয়ে গেল;
মা নেই খাটে-
সিমেন্টের লাল মেঝেয় মাঝ বয়সী দেহটা শায়িত,
পাড়ার কাকিমা গোছের অনেকেই নিজের নিজের মত করে
মা’কে আরাম দেবার ব্যবস্থায় লিপ্ত;
মার মুখে গোঁ গোঁ শুব্দ,
দুজন পায়ের দিকে বসে তলা ঘষছে,
দুজন হাতের তালু,
কাঁচাপাকা চুলে থপথপ জল দিচ্ছে একজন,
বড়মা মায়ের ব্লাউজ খোলা বুকে একটু ম্যাসাজ মত করছে অনভিজ্ঞ হাতে,
আমার হাত পায়ে অসম্ভব কাঁপন।
দরজায় জানালায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভেজা চোখ,
ফিসফাস গলা।
কে একজন ত্রস্ত গলায় বলল,
‘যা তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাক,
নিয়ে যাবার সময় নাই...’
দু’তিন সেকেন্ড লাগল অবস্থাটা বুঝতে,
ঝাঁকুনি পেয়ে ছুটলাম-
ডাক্তার-বাড়ি।
ভেতরে আমার ঝড়,
এলেমেলো কাঁপা স্বরে কোনোমতে বোঝালাম
আমার উৎকণ্ঠা,
হাতে নেওয়া রুগীটা ছেড়ে
উনি এলেন
মিনিট তিনেকের মধ্যে।
মায়ের হাত-পা আস্ফালন আর নেই;
ভিড় বেড়েছে আরো,
কমেছে গঞ্জন অনেক,
কিন্তু
তাদের চোখগুলি বড্ড বেশী সক্রিয়;
মায়ের ঈষৎ-উঁচু পেট ঢাকা রয়েছে
বিধবার শাড়িতে,
হাত-পা ঘষাঘষি সিকিতে নেমেছে,
বড়মার হাত চুপ।
ডাক্তার ঢুকলেনঃ
ঠোঁট ফেরে জিভ দেখলেন,
নাড়ি দেখলেন,
চামচ দিয়ে হাতের তালুতে
পায়ের তলাতে বার কয়েক ঘষলেন;
আমার চোখ আটকে ছিল ডাক্তারবাবুর মুখে,
তাঁর মুখের ছবি পাল্টানোর সাথে সাথে
আমার বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল,
উনি ভিড় ঠেলে
আমার ডান হাত ধরে
একটু ফাঁকায় আনলেন,
যতটা পারা যায়
স্বর নামিয়ে কানে কানে বললেন ,
“শক্ত হ ...
বাঁশ-টাঁশের ব্যবস্থা কর,
তোর মা আর নেই।”
আমি ভাবলেশহীন হয়ে গেলাম।
কি যে হয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমার চোখ এই প্রথম
ফুটো হয়ে গেল।
‘ডাক্তারবাবু, আপনার ফিজ?’
তিনি আমার ঘাড় চাপড়ালেন।
কিছু না বলে অপেক্ষমাণ রিক্সায় চাপলেন,
পরিচিত একজনকে প্রফেসনাল ব্যাস্ত কায়দায় বললেন,
‘সৎকারের ব্যবস্থা কর, ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসিস।’
আমার মুখে কয়েকশো পর্বতের ভার।
মুহূর্তেই-
বেঁধে রাখা বাঁধ ভেঙ্গে পরল।
পথের পাশের সিঁড়িতে দেহটা পরে গেল আমার-
মায়ের কাছেও যেতে পারল না,
গাল বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঝরতে লাগল।
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে লাগল।
অনুভব করলাম কারা যেন আমাকে চেপে ধরে বসাল।
চারিদিকে কতক্ষন কি হতে থাকল হুশ নেই।
কান্নার রোল বেড়ে গেল চতুর্গুণ।


উথলে উঠা দুধ চিরদিন ফুলে থাকে না-
নেমে আসেই একসময়।
যখন চোখ খুললাম
রাত দশটা মত,
আমি বসে মৃত মায়ের বাম পাশে,
হাতের মুঠিতে মায়ের নরম হাত,
সামনের একটি দাঁত ঠোঁটের একটু বাইরে।
প্রতিবেশী কাকিমারা তখনও ঘরের মধ্যে টুকটাক ঘরোয়া সাহায্যে ব্যাস্ত।
মায়ের মাথার পিছনে টবে তুলসী গাছ,
তাতে জ্বলন্ত ধূপকাঠির ছায় পরে চলেছে নিজের ছন্দে,
বাঁশের খাট বাঁধা হয়ে গেছে,
পাশের বাড়ির দেয়ালে সেটি হেলান দিয়ে দাড়িয়ে,
লাশ তোলার অপেক্ষায় ।
শেষ দেখা দেখতে অনেকেই এসেছে বাসে ট্রেনে চেপে।
তাদের ছেলেমেয়েদের দেখভাল সামলাচ্ছেন প্রতিবেশী মহিলারা।
জীবনের নিজস্ব ছন্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে
ঘর থেকে উঠানে নেমেছে লাশ,
যে কিনা আমার মা ছিল।
আজ থেকে তার নামের আগে বসে গেল 'চন্দ্রবিন্দু '
শীতের রাত বলে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে সকালে।
ধন্যবাদ ঈশ্বর।
আর কয়েকটা ঘণ্টা থাকবে মায়ের দেহ আমাদের মাঝে।
রাত বেড়ে চলল...
কেউ দূরে, কেউ কাছে
ঢোলে পরল ঘুমের কোলে,
আমি ব’সে থাকলাম মায়ের পাশে-
কিছুটা শক্ত হতে শুরু করছে দেহ-তন্ত্র।
ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হতে থাকল;
পাড়াময় এক নিস্তব্ধতা,
বহু কায়দায় ঘুম নিয়ে চলল আমাকে
তার নিজের দেশে,
মায়ের জন্য আনা সবুজ মোড়কের চকলেটগুলি তখনও
আমার ডান পকেটে,
ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতেই হচ্ছিল খশমশ শব্দ
আর আমার দুচোখ ফুটো হয়ে যাচ্ছিল।
সেদিন কতবার যে চোখ ফুটো হয়েছিল
তা আজ আর মনে পরে না।