আফগানিস্থানের কবিতা (চতুর্থ পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                   এই কবিতাগুলো সাম্প্রতিককালে রচিত। আফগান কবিদের মৌখিক পরিভাষার সূত্র ধরে এসব কবিতাকে ‘আধুনিক’ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলা কবিতার সমজদাররা যে-অর্থে আধুনিকতাকে অনুধাবন করে থাকেন, খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা হচ্ছে : বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সনাতনী ভাবধারার বিবর্তনের এক বিশেষ ধাপে সৃষ্ট কাব্যকলা, টিএস এলিয়টের ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ যার একটি অনুপম উদাহরণ। কাব্যে মডার্নিটির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে — তা ধ্রুপদী কিংবা রোমান্টিক প্রকরণ থেকে বিযুক্ত হয়ে তৈরি করা, শব্দকারিগরির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক কাব্য-শৈলী। আধুনিকতার কিছু লক্ষণ হচ্ছে — ভাবনা-প্রাধান্য   ও বিষয়বস্তুর সাথে প্রকরণ ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রিক শৈলীর নিরীক্ষা। সাথে সাথে অপ্রচলিত থিমের প্রকাশ, অভিব্যক্তিতে নতুনত্ব, এবং বহুমাত্রিক প্রকাশ-প্রক্রিয়া প্রভৃতিকেও আধুনিকতার নিয়ামক হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

            ‘আদবিয়াতে ফার্সি’ বা ফার্সি অথবা দারী সাহিত্যের অধ্যাপক এবং এই সময়ের কয়েকজন কবির কথায় জানা যায় যে, আফগান কবিদের সাথে কনসেপ্ট হিসাবে আধুনিকতার পরিচয় হয়, ১৯৫০ সালে। তখন অব্দি দারী কবিতায় প্রচলিত প্রধান প্রকরণ ছিল ‘খোরাসানী শৈলী’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভৌগোলিকভাবে খোরাসান বলতে বর্তমানের তাবৎ আফগানিস্তান, আগেকার যুগের পারস্য বা ইরানের বেশ-কয়েকটি প্রদেশ ও মধ্য-এশিয়ার ব্যাপক ভূ-ভাগকে বোঝানো হয়ে থাকে।
ইরান ও আফগানিস্তানে খোরাসানী শৈলী উদ্ভাবিত হয় দশম শতকে। মহাকাব্য রচনার উপযোগী বাহন হিসাবে বিবেচিত এ শৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : অলঙ্কার বহুলতা, প্রতীকী ঢঙের প্রকাশভঙ্গি, ছন্দের সুদৃঢ় বন্ধন এবং অত্যন্ত সাবধানী শব্দচয়ন।
এ ধারার উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে -
আসজাদি, ফারুখি সিস্তানি এবং আনসারি প্রমুখ।
সুফী দরবেশদের মরমী রহস্যময়তা খোরাসানী শৈলীর অন্যতম বিষয়বস্তু।

পঞ্চাশের দশকে ইরান থেকে প্রকাশিত কবিতার সাথে মিথস্ক্রিয়ার প্রকাশ স্বরূপ আফগানিস্তানের দারী ভাষার কয়েকজন প্রধান কবি, যেমন — খালিলুল্লা খালিলি, ইউসুফ আইনা, জিয়া ক্বারিজাদা এবং ফতে মোহাম্মদ মোনতাজির প্রমুখ কবিগণ কবিতার আধুনিকতার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এঁদের সকলেই ছিলেন খোরাসানী শৈলীতে দক্ষ কাব্য-কলাকার। আধুনিক প্রকরণের প্রাথমিক পর্যায়ের নিরীক্ষা হিসাবে তাঁদের হাতে কিছু কবিতা পঞ্চাশের দশকে রচিত হয়ে থাকলেও বিষয়টি ব্যাপকভাবে দানা বাঁধে ষাটের দশকে।

             পাশ্চাত্যের কিছু কবিতার অনুবাদ দারী ভাষায় আধুনিক কবিতার উন্মেষে সাহায্য করে। কয়েকজন কবি যেমন মোহাম্মদ আকবর সায়গান বা আব্দুল হক ওয়ালা প্রমুখ পাশ্চাত্যের কবিতার অনুবাদের সাথে সাথে আধুনিক শৈলীতে মৌলিক কবিতা লিখেও তা'রা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। আবার ষাটের দশকের শেষদিকে আফগানিস্তানে আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) — যিনি কাবুল কান্দাহারে ইকবাল লাহোরী হিসাবে পরিচিত, আবার নতুন করে ব্যাপকভাবে পঠিত হতে থাকেন। দারী কবিতায় অভিজ্ঞ কারও কারও অভিমত হচ্ছে — ষাটের দশকের শেষদিকে ইকবালের ফার্সি কবিতার পুনরায় জনপ্রিয়তা আফগানিস্তানে আধুনিক কবিতার বুনিয়াদকে মজবুত করতে সাহায্য করেছে।

   ষাটের দশকের শেষদিকে নামজাদা কয়েকজন আফগান কবি কয়েক বছর আধুনিক ধারায় কবিতা লিখে পরে আবার ফিরে যান খোরাসানী শৈলী অথবা সনাতনী ধ্রুপদী ধারায় কিংবা অন্য কোনো প্রকরণে।
উদাহরণস্বরূপ, খালিলুল্লা খালিলি 'রুবাই' প্রকরণে ফিরে যান এবং প্রচুর পরিমাণে 'রুবাই' লিখতে শুরু করেন।
জিয়া ক্বারীজাদা 'গজল'
ও ইউসুফ আইনা 'নজম্' রচনায় অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

       দারী কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাতে ইরানে
‘ফ্রি স্টাইল পোয়েট্রি’ বা মুক্তক ঘরানার কবিতার যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড় হয়। ফার্সি কবিতায় মুক্তক ঘরানার উদ্ভবের সাথে ইরানের নারী কবিদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এক্ষেত্রে মুক্তক ঘরানাকে ধ্রুপদী কাব্যপ্রকরণ তথা খোরাসানী ট্রাডিশনের দৃঢ় রীতিকলা ভেঙে ভিন্ন একটি ভাবনাপ্রধান কাব্যশৈলী নির্মাণের উদ্যোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ইরানের যশস্বী মহিলা কবি নিমা ইউশিজ-কে (১৮৯৭-১৯৫৬) মুক্তক কাব্যশৈলীর পায়োনিয়ার বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাঁর নাম থেকে মুক্তক কাব্যশৈলী ‘নিমায়ী’ কবিতা হিসাবে ইরান ও আফগানিস্তানে পরিচিত হয়ে ওঠে।

       আফগানিস্তানেও ‘নিমায়ী’ কাব্যশৈলী বলতে ধ্রুপদী অন্যান্য প্রকরণ ও বিশেষভাবে খোরাসানী কাব্যকলার বন্ধনমুক্ত সাম্প্রতি সময়ের আধুনিক ভাবনা বিষয়ক কবিতাকে বোঝানো হয়ে থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, আফগান কবিতার আলোচনায় ‘আধুনিক কবিতা’ ও ‘নিমায়ী কবিতা’ সমার্থক হিসাবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানে ‘আধুনিক’ বা ‘নিমায়ী’ রীতির সূত্রপাত ব্যাপক অর্থে ষাটের দশক হলেও তা বিশদভাবে বিস্তারিত হয় সত্তর দশকে।  আফগান কবিতার পরিভাষায় ষাটের দশকে যারা আধুনিক কাব্যকলার চর্চা করে লোকপ্রিয় হন তাঁদের ‘নিমায়ী’ ধারার ‘ফার্স্ট ওয়েভ’ বা ‘প্রথম তরঙ্গ’ বলা হয়। সত্তর দশকের দারী ভাষার কবিরা ‘নিমায়ী’ ধারার ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা দ্বিতীয় তরঙ্গের কবি হিসাবে পরিচিত। নব্বই দশক থেকে আজ অব্দি কবিদের অনেকেই ‘নিমায়ী’ ধারার ‘থার্ড ওয়েভ’ বা তৃতীয় তরঙ্গের ধারক হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।

         সাম্প্রতিক কালে আধুনিক বা নিমায়ী ধারার কবিতাতে প্রতিফলিত হচ্ছে সমাজ-বাস্তবতা। বিপুলসংখ্যক কবিতাতে প্রকাশিত হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বাস করার উদ্বেগ-যন্ত্রণা ও মানবিক মর্যাদা স্খলনের হতাশা।

    ঈশ্বরের সাথে রহস্যময় আলাপচারিতা - যা ছিল খোরাসানী ধারার সুফী দরবেশ কবিদের প্রিয় প্রসঙ্গ, তা বদলে গিয়ে বিষয়বস্তু হিসাবে আধুনিক বা নিমায়ী কবিতায় বিধৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত বেদনাবোধ, বিপুল শূন্যতা এবং নারী-পুরুষের পারষ্পরিক ব্যথা-বেদনা,হতাশার কথা।

            এখানে অনূদিত চারজন কবি যথাক্রমে, ওস্তাদ খালিলুল্লা খালিলি প্রথম তরঙ্গ বা ষাটের দশক,  
কবি পারতাও নাদেরী  দ্বিতীয় তরঙ্গ বা সত্তর দশক
এবং কবি নাদিয়া অনজুমন ও কবি রেজা মোহাম্মদী-কে তৃতীয় তরঙ্গ থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
ফার্সি বা দারী সাহিত্যের দু-জন অধ্যাপক ও একজন শিক্ষার্থী কবিতাগুলো ইংরেজিতে আক্ষরিক অনুবাদ করেন।
বাংলা অনুবাদে শব্দের চেয়ে ভাব, বিষয়বস্তু ও প্রতিফলিত আবেগ প্রাধান্য পেয়েছে।

খালিলুল্লা খালিলি / দুইটি কবিতা (আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ : মোহাম্মদ আফতাব ইয়ামা)

কবি পরিচিতি
-------------------------------------------------
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মশহুর আফগান কবি হচ্ছেন ওস্তাদ খালিলুল্লা খালিলি (১৯০৭-১৯৮৯)
পেশাগত জীবনে ইতিহাসবেত্তা হিসাবে উল্লেখযোগ্য, অধ্যাপনা করেছেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে, দায়িত্ব পালন করেছেন রাষ্ট্রদূতের, এমনকি পাঁচের দশকে মন্ত্রী হয়েছিলেন স্বল্পমেয়াদে। ওস্তাদ খালিলি ধ্রুপদী সিলসিলার সর্বশেষ কবি হিসাবে যেমন সন্মানিত, তেমনি হাল-জামানায় যারা আধুনিক ঘরানার নিমায়ী শৈলী প্রবর্তন করেছেন তাঁদেরও অন্যতম হিসাবে স্বীকৃত। ওস্তাদের প্রথম দিকের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে খোরাসানী শৈলীতে লেখা কবিতায় তাঁর অসামান্য দক্ষতা।    
       লোকনন্দিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘আশখা ওয়া খুনহা’ (অশ্রু ও রক্ত) এবং ‘আয়ের ই-অজ খোরাসান’ (খোরাসানের বীরেন্দ্র কেশরী) উল্লেখযোগ্য।
_____

প্রজাপতি ও পর্বত
-------------------------

পর্বত - ঢেউ খেলানো পাথরের মহিমায় মহান
চূড়া দীপ্ত ব্যপ্তি তোমার ছুঁয়েছে সুনীল আসমান।
মুগ্ধ থাকবে আত্মপ্রেমে আর কতকাল?
প্রজাপতি - অত্যন্ত ছোট্ট পতঙ্গ আমি
বর্ণাঢ্য ডানায় গতিময় আমার হালচাল,
আমি মুক্ত-চঞ্চল চলোর্মিতে অধীর,
নৃত্যে মাতি পুষ্পকুঞ্জে —
আর তুমি সুপ্ত-পাথরের শৃঙ্খলে স্থবির।।

তিক্ত ফল আমি
----------------------

ঝরে পড়ছি আমি মৃত্তিকায় - তিক্ত এক ফল
সময়ের আঁকশিতে আটকানো আমার অস্তিত্ব
.                                       অতীব অসফল।

মুক্তির হে বসন্ত
-------------------------

তিতকুটে মেওয়াকে সুবাতাস বৃষ্টিতে সুমিষ্ট
করা ভিন্ন কীই-বা হতে পারে তোমার অন্বিষ্ট?
সম্ভাবনার দোলাচলে কখনো উদ্দীপ্ত আমার চিত্ত
বান্ধব-সঙ্গই হচ্ছে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় বিত্ত;

মৃত্যুর মতোই কষ্টকর তাদের বিচ্ছেদ
যেহেতু তারা সমবেত বিশ্রামে নিমগ্ন কবরগাহে
আমিও চলেছি ধ্রুবতারার আলোয় একই রাহে,
ধূলিশয্যায় নেই-তো সম্ভ্রম সম্পদের ভেদাভেদ;
মৃত তারা, জীবিত হলে কী-বা হতো তারতম্য?
আমাদের জীবন থেকে তো পেয়েছে লোপ
সুস্বাস্থ্য আর যা-কিছু ছিল সুশোভন সুরম্য।

যন্ত্রণা গড়ছে আমাকে বিষাদের ছাঁচে
রেখেছি জীবনবোধের আনন্দ যে-পেয়ালায়
তা ফুটছে দুঃখের তীব্র আঁচে;
জ্বলছি আমি
বাতাসে মোমের মতো পুড়ছি
                               মৃত্যু হচ্ছে
                                       ঝরে পড়ছি
                                                  কাঁপছি সতত।


পারতাও নাদেরী / তিনটি কবিতা (আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ : মোহাম্মদ আফতাব ইয়ামা)

কবি পরিচিতি
----------------------
কবি পারতাও নাদেরীর জন্ম ১৯৫৩ সালে বাদখশানে।
পড়াশোনা কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাতের দশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতার জন্য পুলে-এ-চরকীর কুখ্যাত কারাগারে তিন বছর অবরুদ্ধ হালতে কাটান। আধুনিক ঘরানার কবি হিসাবে লোকনন্দিত পারতাও নাদেরী অনেক বছর পরবাসের পর বর্তমানে ফিরে এসেছেন কাবুলে। তিনি লেখকদের সংগঠন ‘পেন’-এর আফগান চ্যাপ্টারের সভাপতি।
______

শূন্যতা
-------------

তোমার কর-রেখায় প্রতিফলিত সৌরমণ্ডল
রশ্মিতে ছড়াচ্ছে অদৃষ্টের আবীর,
হাত তোলো
             উঠে দাঁড়াও
             দীর্ঘরাত তোমাকে করে দিচ্ছে স্থবির।

এখনো আছে সময়
অনেক আগেই অতিক্রম করেছি মধ্যরাত
ধূলি-ধূসরিত হয়েছে সততার আয়না
এসেছে সময় প্রার্থনার
                  দু-হাত তুলে করেছি মোনাজাত।

উঠে-পড়া উচিত আমার
                          অতিক্রান্ত হয়নি বেশীক্ষণ,
মদিরার সাথে জলভরা জগের তফাৎ
                 এখনো ধরতে পারে আমার মন।

জীবনের অসমতল ঢালু বেয়ে নামছে সময়ের রথ
আগামীকাল হয়তো বিষমাখা তীরে
.                            বিদ্ধ হবে আমার দু-চোখ
অন্ধকারে বিলুপ্ত হবে এগিয়ে যাবার পথ।

আমার শিশুরা বৃদ্ধ হবে আগামীকাল
               অপেক্ষায় থাকবে তারা প্রত্যাগমনের
উপত্যকার শান্ত বাতাস হবে হয়তো ঝড়ে উত্তাল।


আয়না
-------------

জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছি আমি ভিনদেশে
শহর থেকে গ্রামে পরবাসে
উপত্যকা থেকে পর্বতে
.                         হেঁটেছি আমি তীব্র সন্ত্রাসে।
অনুভবের আয়নায় খুঁজেছি নিজের প্রতিফলন
প্রজ্ঞার প্রমিত দ্বন্দ্বে বেজেছে আমার সত্তা
নাস্তির অর্থহীন ছন্দে হয়েছে উন্মন।


নাদিয়া আনজুমন / তিনটি কবিতা (আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ : ফিরিশতা সমন্দর)

কবি পরিচিতি
---------------------
কবি নাদিয়া আনজুমন (১৯৮০-২০০৫)-
এর জন্ম হিরাতে। দশম শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়াকে বালিকা বিদ্যালয় ত্যাগ করে পর্দার অন্তরালে যেতে হয় — তালেবানী শাসন নারীশিক্ষা সাফ হারাম ঘোষণা দিলে। অতঃপর কবি ‘সোনালি সেলাই চক্র’ বলে খ্যাত মেয়েদের কাপড় সেলাইয়ের ছদ্মাবরণে সংগঠিত সাহিত্য বিষয়ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টাডি সার্কেলের সদস্য হন। তালেবানী শাসন বিলোপের পর হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্রী থাকাবস্থায় প্রকাশ করেন তাঁর পয়লা কাব্যগ্রন্থ ‘গুল-ই-দোদি’ বা ‘আঁধার প্রসূন’। বিবাহিত হন হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ফরিদ আহমদ মাজিদ নেইয়া-র সাথে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কিছু বিষয়বস্তু নিয়ে স্বামী তীব্র আপত্তি জানান। সূত্রপাত হয় দাম্পত্য কলহের। ঈদের দিন কবি নাদিয়া কবিতার মাইফেলে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে স্বামী পর্দার অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ঐদিন কলহের এক পর্যায়ে স্বামীর তীব্র প্রহারে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি নিহত হন। ২০০৭ সালে তাঁর কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয় ইরান থেকে।

________

আফগান দুহিতা
----------------------

কীসের কবিতা?
কী আমি পাঠ করব বলো —
ইচ্ছে হয় না মুখ খুলতে,
ঘৃণা করেছে সরবে সমাজ
সমকাল দেবে না আমাকে
                       মাথা তুলতে।

কীভাবে করব আমি প্রতিবাদ?
ঠোঁটে ছোঁয়াতে চাই যে মধু
বিষ লাগে তা — মুখে  বিস্বাদ।

যারা রুদ্ধ করেছে আমার বাক-স্ফূর্তি
কীভাবে জানাই ধিক্কার?
বাস করছি এমন এক দুনিয়ায়
শুভার্থীও নেই কোনো — তারিফ করার।

আমি কাঁদি কিংবা হাসি
যায় আসে না কারও কিছু,
যদি-বা হয় আমার মরণ
বন্ধ করে দেয়াই সমুচিত
বিশেষ বাচনভঙ্গি
       আমার কবিতা পাঠের ধরণ।

বন্দী আমি আমারই অনুশোচনার
রুদ্ধ হয়েছে সম্ভাবনার সকল দুয়ার,
আমি জানি-বসন্ত,
আমার আনন্দের ঋতু হয়েছে অতিক্রান্ত
ডানা কাটা … কীই-বা করতে পারি
                                আমি পরিশ্রান্ত।

কিন্তু যাইনি ভুলে হৃদয়ের কথা
বিন্দু বিন্দু করে আমার নিজস্ব সিন্ধুতে
                   জমা হচ্ছে সংগীতের প্রবাল
আমার সমুদ্রতলে বেজে যাচ্ছে
           গহন অতলে সুর সকাল বিকাল।

আমারও আসবে সুদিন
ভাঙব খাঁচা,
দিলখোলা এক প্রান্তরে গাইব আমি গান
                         সুর জ্বলে যায় অন্তরে।

সহিষ্ণু বৃক্ষ এক
আমার পত্রালিতে ঝলমল করে
                             সূর্যের সবুজ দর্পণ,
অবরুদ্ধ হবে, নিষ্পেষিত আমার অন্তর
        তবুও করব না আমি আত্মসমর্পণ।

আফগানদুহিতা আমি
শিকড় আমার অনেক গভীরে প্রোথিত
ক্রমাগত ক্রন্দনই আমার ভাগ্য
                        কেঁদে যাবে প্রতিনিয়ত।

এখন গভীর রাত
কিছু ধারণা উদ্ভাসিত হচ্ছে আমার ভিতর
এখন গভীর রাত আমার কাছে
কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে শব্দের প্রপাত,
পুড়ছি আমি — অন্তরে ঝলকাচ্ছে
                রক্তে-নীল-হয়ে-আসা অনল
প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে অনিকেত অগ্নি
জানি না কী ভাবে জুড়াবে
                                কোথায় পাবো জল?

আমার শরীর ছাপিয়ে উঠে আসছে
আত্মার সৌরভ
ঠিক জানি না কোথায় এ শব্দরাজির উৎস-মূল
                 আমার ভিতর প্রগাঢ় হচ্ছে অনুভব।
উবে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতা — বইছে সুবাতাস
মেঘমালায় ঝলসাচ্ছে বিজলি
দূরাগত হচ্ছে আমার হৃদয়ের ক্রন্দন
                                     মিইয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস।

ঝলমল করছে নক্ষত্র
নীহারিকা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে ধুমকেতুর দিকে,
ডানা মেলছে আমার নিজস্ব পাখি
                                স্পর্শ করছে আকাশ
তৈরি হচ্ছে ছায়াপথে আলোকের সেতু।

তাঁর পবিত্র রোজনামচায় বিধৃত হচ্ছে
                                       আমার উন্মাদনা
তোমাকে কী-না বলতে পারি?
কী চাও তুমি হে আমার প্রভু
তোমার জন্যই তো হয়েছি আমি যে উন্মনা।

তাকাও একবার আমার দিকে
আজই তো সমাপ্তি
                মনে হয় আমার রোজ-কেয়ামত,
বাঙ্ময় হয়ে উঠছে অনেক দিনের নীরবতা
                  দেখাও আমাকে জ্যোতির্ময় পথ।

আমি তৃপ্ত, পড়ছে মনে সব কথা
আমাকে তো দিয়েছ রেশম
                            গোলাপের স্নিগ্ধ সুবাস,
ছড়িয়ে পাপড়ি সারারাত এম্ব্রোয়ডারি করি
                            কবিতার পুষ্পিত ফরাশ।

লুকিয়ে থাকে যে
লুকিয়ে থাকে যে অচেনা পাহাড়-পর্বতের অন্তরালে
সুপ্তিতে নিমগ্ন হয়  
ঝিনুকের নীরবতার ভেতরে মুক্তো
সমুদ্রের শুভ্র ফেনা প্রচ্ছন্ন থাকে প্রবালে।

বসবাস করে যে কেবলমাত্র স্মৃতিময়তায়
আমার ভেতর বয়ে যায়
                     বিস্মৃতির নদী
                        জমছে মনে ধূসর ধুলো নিরবধি।

অপরিচিত বনানী গুহাকন্দরের আড়াল থেকে
                                ভেসে আসে যে মন্দ্র স্বর
স্মরণ করিয়ে দেয় আমাকে
     কোথায় আমার মূল ঠিকানা,  নিজস্ব ঘর।

বিনাশ প্রয়াসী যিনি
কখনো ডেকে আনেন ধ্বংস
সৃষ্টির বিপরীতে উজাড় করেন ঝাড় ও বংশ,
কীভাবে তোমাকে দেন তিনি
. মেঘের মেদুর সূত্র বিজলির সোনালি তসবির
তাঁর নির্দয়তার তুফানে,ছড়ায় দিগন্তে ঝড়-সমীর;
ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার বিশ্বাসের আশা
                          সমুদ্রের উর্মিমহলে টালমাটাল
কীভাবে একটি রূপালি পত্র দিতে পারে তোমাকে
চন্দ্রের শুশ্রূষা, দেখাতে পারে আকাশের সুরত-হাল?

কোনোকিছুই তো হারায় না এই দুনিয়ায়
                             তাবৎ বস্তুনিচয় অবিনশ্বর,
যদি ভাটা পড়ে নদীর প্রবাহে
মেঘদলে ভেসে যায় বৃষ্টির নৌ-বহর;
আর চাঁদের দুহিতা যদি শুভাশিষ জানায় স্মিত হাস্যে
পাহাড়ে জন্মায় ফলদায়ী বৃক্ষ
                 ছড়ায় সবুজ পত্রালি শ্যামলিমা লাস্যে,
আর নির্দয়তার ছদ্মবেশ ছেড়ে যদি
                   বেরিয়ে আসো তুমি অনুকম্পাশীল
সূর্য কী উঠবে আবার  বইবে সুখ-স্মৃতিময় সুবাতাস
গোলাপ প্রসূনে সুরভিত হবে আমার নিখিল।

যে-স্মৃতি লুকিয়ে আছে আমার চোখে
                                 যখন সত্তা ছিল বিপদগ্রস্ত
ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা-মারী ও মড়কে হয়েছি ভীত সন্ত্রস্থ,
তবে কী প্রত্যাশার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে
                                                দিগন্ত আবার
দেদারে তাঁর বিধৃত হবে মহিমা অপার?

রেজা মোহাম্মদী / দুইটি কবিতা (আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ : গুল মোহাম্মদ তানিন)


কবি পরিচিতি
----------------------
জন্ম ১৯৭৯ সালে কান্দাহারে। যুদ্ধে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন শৈশবে। কৈশোরের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন পাকিস্তান ও ইরানের শরণার্থী শিবিরে। তরুণ বয়সে অভিবাসী হন ইংল্যান্ডে। পড়াশোনা করেন মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটিতে। পেশাগত জীবনে সাংবাদিক হিসাবে কর্মরত। বিলাতে স্থায়ীভাবে প্রবাসী হলেও তার চিত্রছন্দময় কবিতা আফগানিস্তান ও ইরানে জনপ্রিয়।

______

অবৈধ অভিবাসী
------------------------

সূর্যোদয় হয়েছে পাহাড়ের ওপাশে
ভাসছে শান্ত শুভ্র মেঘদল
     বইছে সুবাতাস নির্মল উচ্ছ্বাসে

আর বাক্স-পেটরা নিয়ে পৌঁছাচ্ছে সীমান্তে
কম্বল, কেতলি ও পুতুল একটি ঝুলছে
             দড়িতে বাঁধা স্যুটকেসের প্রান্তে,
এসে জমা হচ্ছে অনেক ভিনদেশী পরিবার
ওপারে জম্পেশ করে জমেছে কী পার্টি?

ভেসে আসছে মিউজিকের সুর-বাহার।
কারা মেতেছে বুঝি যুগল নৃত্যে
ছত্রখান হচ্ছে পানপাত্র মদির হাস্যরোলে
নবীন তরুণ এক পরিয়ে দিচ্ছে ফুল
.                            যুবতীর সোনালি চুলে।


আর এদিকে আমি
-------------------------

হাতে নিয়ে আমার ধুক-পুকে দরাজ হৃদয়,
লুকিয়ে আছি কার্গো জাহাজের নীচের কুঠুরিতে
                       হানা দিয়েছে মনে তীব্র ভয়।

অথবা আমার শরীর দড়িতে শক্ত করে বাঁধা
                       চব্বিশ চাকার ট্রাকের তলায়,
অতিক্রম করছি সীমান্ত
না-বলা বাক্যের কাঁটা আটকে আছে গলায়।

প্রবেশ করতে যাচ্ছি মহিমাময় বিলাতি জগতে
আর যাব না ফিরে এসেছি যে পথে,
পেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত তীব্র প্রতীক্ষায়
আজানা দেশে আগন্তুক আমি নিতান্ত নিরূপায়।


অ্যালবাম
---------------

কুঁকড়ানো অলকগুচ্ছে খেলা করছে
তোমার সুচারু আঙুল
ছড়িয়ে পড়ছে মুখে চিকন কিছু চুল।

চোখজোড়া যেন শরাবের পেয়ালা
মহান মায়ায় জাদুময়,
পানে উদগ্রীব আমি
.              হয়েছি নেশাগ্রস্ত তন্ময়।

পরের ছবিতে খেলছে দুটি শিশু
ওরা সেজেছে ভূত,
কাছাকাছি আমাদের বাহু, দুটি হাত
স্পর্শের ওমে আঁকা এ ছবি নিখুঁত।

পাতা উল্টাই অ্যালবামে
খেলছে বাচ্চাদুটি ডানে ও বামে,
নিমগ্ন হওয়া কী উচিত নিত্যদিন, পরষ্পর?
আমরা তো হইনি কখনও তা
আমাদের অদৃষ্ট নিয়ে খেলছেন যে ঈশ্বর!

পরের ছবিতে দুটি খাঁচায়
ভিন রঙের জোড়া পাখি খুঁটে খায় শস্যের দানা,
লুকোচুরিতে আমাদের শিশুরা ভাঙছে নিষেধের সীমানা।

তুমি তো নেই পরের পৃষ্ঠায় আমাদের গুপ্তধন
   শিশুদের খেলাধুলা স্বপ্ন সৃজন, মরে যায়,
                         সবকিছু নিমেষে মুছে যায়।

পরের ছবিতে আবার যখন যুক্ত হয় তোমার আনন,
নদী বয়ে যেতে চায় সবুজ উপত্যকায়
                    সৌরভের সাথে চলে বর্ণের রমণ।

ক্রীড়াপ্রিয় হরিণের মতো
আমার চোখদুটি তোমাকে করে অনুসরণ,
সুচারু আঙুল চুলে তোলে ঊর্মিময় অনুরণন,
অলক-চূর্ণে আবার ঢেকে যায় তোমার মুখ
সরাবে কখন চাঁদকুড়ো চুলের বাহার
        আমি হয়ে আছি দর্শনে রঙিন — উন্মুখ।