আফগানিস্থানের কবিতা  (পঞ্চম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                 বিশ্ব জীবনযুদ্ধের কাহিনী শরণার্থীদের কবিতায়। আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যারা পৌঁছেছে ইউরোপে। চোদ্দ থেকে আঠারো বছরের এমন কয়েকজন আফগানের কবিতায় উঠে এলো ঘর হারানোর যন্ত্রণার কথা৷
যুদ্ধের ভয়াবহতা৷

‘‘পৃথিবী যখন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায়,
তখনও জেগে থাকি আমরা
পেটে খিদে
বুকে তৃষ্ণা
পরিশ্রান্ত৷''

          যে লিখেছে, তার বয়স মাত্র পনেরো বছর।
আফগানিস্তান থেকে ইরান হয়ে এসে পৌঁছেছে সুদূর জার্মানিতে৷
        ইয়াসের নিকসাদা একা নয়, তার মতো আরও বহু কিশোর-তরুণ ইউরোপে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে আফগানিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য৷ তারা 'দিবা-রাত্রির কাব্য' চর্চা করে চলেছে সর্বদা৷ যখনই সুযোগ মিলছে৷    

         সেইসব কবিতা নিয়েই সম্প্রতি জার্মানিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল৷ পুরস্কৃত করা হয় কমবয়সি ৬ জন আফগান কবিকে৷ তাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে৷ নিজেদের কবিতায় সকলেই লিখেছে দেশ ছেড়ে আসার যন্ত্রণা এবং ভয়াবহতা৷
ইয়াসেরের কাছাকাছি বয়সের আরেক কবি লিখেছে, -
‘‘চোখের সামনে
গ্রামের সমস্ত মানুষকে
মেরে ফেলছিল ওরা৷
একসময় সেই রক্তপাত বন্ধ হলো,
আমরা বুঝতে পারলাম,
কাবুলের পাখি বাজার পুরনো শহরে
আজকের মতো রক্তের খিদে শেষ হয়েছে ওদের৷"
          
        জার্মানির  L S - 'লাসকার-শুলার' সোসাইটি দিয়েছে এই পুরস্কার ছয়জন  তরুণ আফগান কবিকে৷
          অনেকেই জানেন, শুলার নিজেও ছিলেন এক বিশিষ্ট কবি এবং শরণার্থী৷ ইহুদি শুলার নাৎসি আমলে জেরুসালেমে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ তাঁর কবিতাতেও ধরা পড়েছিল শরণার্থীর যন্ত্রণা৷ ভিনদেশে জীবন কাটানোর যন্ত্রণা জড়িয়ে ছিল তাঁর লেখার পরতে পরতে৷ সে কথা মনে রেখেই প্রতি বছর শুলারের নামে একটি পুরস্কার দেয় শুলার ট্রাস্ট৷ এবার (২০১৮-সালে) সেই পুরস্কার পেলেন আফগান ছয়জর উঠতি তরুণ কবি।

     পরিবার বিচ্ছিন্ন এইসব কিশোররা জানে না, আদৌ তারা আর দেশে ফিরতে পারবে কিনা৷
     ইয়াসের যেমন বলেছে,
"ভিনদেশে চলে আসা কঠিন৷
  কিন্তু আরো কঠিন নিজের দেশে ফিরে যাওয়া৷"

   সে রাস্তা আপাতত বন্ধ৷ কিন্তু তারা ফিরতে চায় দেশে৷ দেখা করতে চায় পরিবারের সঙ্গে৷ পরিবার ভালো না থাকলে নিজেদেরও ভালো রাখা যায় না৷ তাদের কথায় সেটা পরিস্ফূট।

   আফগান তরুণদের লেখা পড়ে এবং কথা শুনে মুগ্ধ জার্মানির বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা৷ অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলেছেন, বয়সের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গিয়েছে ওই সব কবিরা৷ কারণ, জীবনযুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখে ফেলেছে ফেলেছে তারা৷ যদি তাদের মতো প্রতিভাদের পাশে দাঁড়ানো যায়, তবে একটা অন্যরকম সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল করা যাবে বলে জার্মানির মানবাধিকার সংগঠনের ধারণা৷

        রাজনীতি চলে রাজনীতির মতো, কূটনীতি কূটনীতির মতো ৷ সেখানে কেবলই যুদ্ধ আর হানাহানি৷ তবু মানবতার জন্য যুদ্ধ আগেও ছিল, এখনো আছে৷ সে ব্যাটন কখনো ছিল লোরকার মতো কবিদের হাতে, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও যাঁরা কবিতা বলতে পারতেন বুক উঁচিয়ে।
ছিল কবি একরম্যানের হাতে সেই ব্যাটন৷
         অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনাল-এর যে কবি ঔপনিবেশিক দাসত্বের কথা লিখেছেন নিজের কবিতায়৷
   এখন হয়তো সেই ব্যাটনই চলে এসেছে অসংখ্য আফগান, সিরিয়ো শরণার্থীদের হাতে৷ জীবনের এক অন্য উপাখ্যান লিখছেন তাঁরা৷