ল্যাটিন সাহিত্যে নিকানোর পাররার কবিতা (পর্ব - দুই)
- শংকর ব্রহ্ম


সবক্ষেত্রেই এই ধারাবাহিকতা, রাজনীতি সমাজনীতি সাহিত্য চলচ্চিত্র কবিতা সবখানেই। কার্ল সাগান বলেছিলেন, 'মানুষ দুনিয়াতে নাই বা মানুষের অভিজ্ঞতায় নাই সেরকম কিছু কল্পনা করতে পারে না।' আবার শিল্পে সাহিত্যে আগে ঘটে নাই বা ভূঁইফোড় কিছু হতে পারে না। যা হচ্ছে তা আগেরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু অনেক সময় পুরাতন থেকে নতুন বেরিয়ে আসার সময় একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নতুনকে আমরা মেনে নিতে পারি না সহজে। বাদ প্রতিবাদ হয়। যারা বুদ্ধিমান, ইতিহাসের যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষীসাবুদ যাদের কাছে মজুদ তাঁরা শুরুতেই বুঝে যায় এ নতুন মোড়ক।
           নিকানোর পাররার এই প্রতিকবিতা যখন প্রথম প্রকাশিত হয় বইটা হাতে নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছিল। চিলির আরেক কবি নেরুদার সাথে একলাইনে যার নাম উচ্চারণ করা হয় সেই পাবলো দে রোকা এই বইটি হাতে নিয়ে লেখেন ‘এই সব স্থূল, বদখৎ, গোঁয়ার, অলস ওড়গুলো, মৈথুনের পূর্বকল্পনা আর সচেতনভাবেই যাদের জীববিদ্যা আর উদ্ভিদবিদ্যা থেকে টেনে আনা হয়েছে। প্রতিকবিতাগুলো এই বিষম করুণাযোগ্য আর বমিজাগানো ভাঁড়ামোরই দ্বিতীয় সংস্করণ।'
           গীর্জের অধ্যক্ষ ফাদার সালভাতিয়েররা বলেছিলেন, 'নিকানোর পাররার ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ এতই অনৈতিক ও নোংরা যে ময়লা ফেলার ডাস্টবিনেও এটা ফেলা যাবে না কারণ গারবেজ ক্যান অবৈধ সন্তানকে জায়গা দিলেও এত অনৈতিক নয়।’
অন্যদিকে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘নিকানর পাররা আমাদের ভাষার মহত্তম নামগুলির অন্যতম।’
‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ বের হবার পর হুলুস্থল পড়ে গিয়েছিল। একদিকে যেমন তুমুল আক্রমণ অন্যদিকে বিপুল সমর্থন। নিকানোর পাররার চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো বিশ্বকবিতার রোলারকোস্টার।

" আধ শতাব্দী ধরে
কবিতা ছিলো বেহেস্ত
গরুগম্ভীর সব বেকুবদের জন্যে
যতক্ষণ-না আমি এসে হাজির হলাম
আর তৈরি করলাম আমার রোলারকোস্টার।"

" ওঠো,চলো, যদি তোমার ইচ্ছে হয়।
এতো আর আমার দোষ নয় যে তুমি হুমড়ি খেয়ে পড়েছো
আর তোমার নাকমুখ দিয়ে দরদর ক’রে রক্ত বেরুচ্ছে।
[রোলারকোস্টার; শ্রেষ্ট কবিতা ও প্রতিকবিতা]"

       নিকানোর পাররার প্রায় সব কবিতাই খাপখোলা তলোয়ারের মত। কবিতা, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন মনোবিজ্ঞান, রাজনীতি, সবকিছুকেই তিনি সেই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন, খোঁচান। কিন্তু সেই আঘাত যেন মধুময়, রসসিক্ত। এ যেন বার্ণাড শ’র সেই উক্তির মতই, 'চূড়ান্ত অপমান করার সময়ও চূড়ান্ত রসিক হতে হবে।' নিকানোর পাররার এই কবিতাগুলো আঘাত আর রসবোধ পরস্পরের জায়গা তৈরি করে। তিনি অবলীলায় শ্ল্যাং শব্দও ব্যবহার করেন অসায়াসে যা কিন্তু মোটেও যেন শ্ল্যাং নয়।

" কোনো প্রার্থনা চলবে না, হাঁচিও না।
থুতু ফেলা নয়, বাহবা দেয়া নয়, হাঁটু গেড়ে বসা নয়,
পুজো না, চীৎকার না, ডুকরানি না,
কেশে কেশে কফ তোলা না।
এ তল্লাটে ঘুমোবার অনুমতি নেই।
কোনো টিকে দেয়া না, কথাবার্তা না, দল থেকে তাড়িয়ে দেয়া না।
চো-চো দৌড় না, পাকড়ে ফেলা না।
ছোটা একেবারেই মানা

ধুমপান নিষেধ। সঙ্গম বারণ।
[হুঁশিয়ারি; শ্রেষ্ট কবিতা ও প্রতিকবিতা]"

              তার কবিতাকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে উদ্ভট খাপছাড়া সেই মানুষের মত যে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাটে। মেদহীন ঝরঝরে আপাত রসিক কবিতাগুলো একেবারেই অব্যর্থ তীর। প্রচুর জাম্পকাট ব্যবহার করেন তিনি কবিতায়।
             গত শতকে গল্পে কবিতায় বেশ ক’জন নিরীক্ষধর্মী লেখক জন্ম নিয়েছেন, নিকানোর পাররা, মিরোস্লাভ হোলুব, তাদেউশ রোজেভিচ, কার্লোস ড্রুমন্ড ডি আনরান্ডি, অরহান ভেলি কানিক, রোজা আইসল্যান্ডার, ফের্নান্দ পেসোয়া, বোর্হেস, ইতালো কালভিনো, পিটার বিকসেল, মিলান কুন্দেরা প্রমুখ। আরও অনেকেই আছেন। এরা বিভিন্ন দেশে বা ভিন্ন ভিন্ন শহরে বসে কবিতা গল্প লিখেছেন কিন্তু তাদের সম-মানসিক সাহিত্যচর্চা বা চিন্তার কারণে বেশ সিমিলারিটি চোখে পড়ে। যেমন জার্মান ভাষার গল্পকার পিটার বিকসেলের একটা গল্প পড়েছিলাম তার ‘শিশুগল্পিকা’ বইয়ে। গল্পে একজন নায়ক জাগতিক সব ট্রাডিশনের উপর বিরক্ত হয়ে সবকিছুর নাম বদলে দিতে থাকে। এটার নাম ওটা ওটার নাম এটা এইরকম করতে করতে সে নতুন এক ভাষা তৈরি করে ফেলে। একসময় সেই ভাষা আর কেউ বোঝে না। সে ভাবে আজ সে সফল। সে সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা তৈরি করেছে যে ভাষা সে ছাড়া আর কেউ বোঝে না। নিকানোর পাররার একটা কবিতা আছে ‘নামবদল’ নামে যেখানে তিনিও সবকিছুর নামবদল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন -
" কোন কারণে সূর্যকে
চিরকাল সূর্য বলে ডাকা হয়?
আমি বলি তাকে ডাকা হোক
চল্লিশ-লিগ জুতোর বিল্লি বলে।
আমার জুতোগুলোকে কফিনের মতো দেখাচ্ছে বুঝি?
জেনে রাখুন আজ থেকে
জুতোকে বলা হবে কফিন।
[নামবদল: শ্রেষ্ট কবিতা ও প্রতিকবিতা।]"

            আপাত নিরীহ এইসব কবিতা আসলে নিরীহ নয় তবে তার আক্রমণের স্টাইল ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনাহীন হয় না লাতিন আমেরিকার কোনো সচেতন শিল্প। কারণ সেখানে শতকজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গেড়ে বসেছে। লাতিন আমেরিকার প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে। হয় সরাসরি না হয় তাদের তাবেদার সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে। চিলিতে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল।
তাই তিনি লিখেন - "  ইউ এস এ/ যেখানে স্বাধীনতা একটা মূর্তি/ ফিদেল যদি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ হত/ সে আমাকে বিশ্বাস করতো/ ঠিক যেমন আমি তাকে বিশ্বাস করি। [হাতের কাজ]"