কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল পরিচিতিঃ মজিবুর রহমান বুলবুল এর জন্ম ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৫৬, বাজিতপুর কিশোরগঞ্জ। স্ব-গঠিত ও স্ব-শিক্ষিত মানুষ। দুই যুগের বেশি - বহিঃর্বিশ্ব পর্যটনের সুবাদে বহু দেশ, সমাজ ও কৃষ্টি-সভ্যতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছেন। সাহিত্যের প্রতি গভীর ঝোঁক থাকলেও কর্মজীবনে নিবিড় সাহিত্য সাধনার সুযোগ পাননি। অবসরে এখন সাহিত্যচর্চাই তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। নানান মিডিয়া ও পোর্টালে নানান ছদ্মনামে লেখালেখি করে অবশেষে ‘অনিরুদ্ধ বুলবুল’ নামটিই সাহিত্য মহলে স্থায়ী হয়েছে। দুই বাংলার বিভিন্ন মিডিয়াতে লেখা ছাড়াও নানান পিডিএফ সংকলনে তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে।


প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ এককগ্রন্থ: (কবিতা) - স্বপ্ন কাজল, সময়ের বাওকুড়ানি, বাইনারি সুখের পিদিম, যাপনের খেরোখাতা, দলিত আকাশ, স্মৃতির শার্শি, পরিযায়ী আলোর দ্যুতি।(প্রবন্ধ)- মন বাতায়ন (গল্প)- নরকের ফোন-কল। সম্পাদনা: (কাব্য সংকলন)- কাব্য কৌমুদী, সম্ভার, সঞ্চয়ন, চয়নিকা, জলতরঙ্গে কাব্যভেলা, দ্বাদশ রবির কর, যে স্মৃতি কথা বলে, তোমার টানে, নরকের কপাট খুলে, বেলা শেষের রঙ, নিয়তির ডুবুচর, গুররান মুহাজ্জালিন, চৈতন্যে ঘূর্ণিঝড়, ঐশী আলোর ছটা, মানুষের কথা, আমার আমি, মুজিব বলছে, আলোর মিছিল সাহিত্যপত্র............


অনিরুদ্ধ বুলবুল ৮ বছর হলো বাংলা-কবিতায় আছেন। আসরের পাতায় এ পর্যন্ত ৪৮৬টি কবিতা এবং আলোচনার পাতায় ১০৬টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।


সম্প্রতি অর্ক প্রকাশনী থেকে, কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল এর ৩টি প্রকাশিত গ্রন্থ আমার হাতে এসছে, সবগুলোই ভিন্নধর্মীর গ্রন্থ, তার নিজের কবিতা এবং কবিতা সম্পর্কিত পাঠকের মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা।


১। স্মৃতির শার্শি ( সেপ্টেম্বর ২০২০)- ১৬টি কবিতা এবং পাঠকের মন্তব্য ও আলোচনা
২। পরিযায়ী আলোর দ্যুতি (অক্টোবর ২০২০)- ১৮টি কবিতা এবং পাঠকের মন্তব্য ও আলোচনা
৩। দলিত আকাশ (অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০)-১৪টি কবিতা এবং পাঠকের মন্তব্য ও আলোচনা


আজকে রিভিউ পর্বে থাকছে, প্রথম গন্থ স্মৃতির শার্শি


রিভিউ স্মৃতির শার্শিঃ


গ্রন্থটি একটি বিশেষত্ত হলো, কবিতা এবং কবিতা সম্পর্কে পাঠক মন্তব্য, আলোচনার সংযোজন যা নুতন পাঠককে কবিতার দিকে টেনে নিয়ে যায় আবার কবিতার না বোঝা অংশটুকুর পাঠক মন্তব্য কিংবা কবি’র মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া থেকে পাঠোদ্ধার করার সুযোগ তৈরি হয়। শুধু কবিতার বই কিংবা কবিতার উপর আলোচনা নিয়ে অনেক গন্থই প্রকাশ হয় কিন্তু কবিতা নিয়ে সরাসরি পাঠক এবং কবি’র মধ্যেকার  কথাপোকথন নিয়ে এটা ব্যক্তিক্রমধর্মী গ্রন্থ নিঃসন্দেহে।


অবতরণিকা তে কবি লিখেছেন-কবিতার বাইরের কিছু আধুনিক পরাবাস্তবধর্মী বিমূর্ত কিংবা আধা বিমূর্ত কাব্য এবং তার পাঠক মন্তব্য নিয়েই এই কাব্যগ্রন্থ। পরাবাস্তব কবিতা অনেক সময়ই পাঠক বুঝতে পারে না, অথচ পাঠকবোদ্ধাগন কীভাবে এর মূল্যায়ন করেছেন তা পাঠক পড়লে এ জাতীয় কবিতা সম্পর্কে পাঠকের ধোঁয়াশা অনেকাংশেই দূর হতে পারে।


গ্রন্থের ভূমিকা থেকেই জানা বোঝার যাত্রা শুরু হয়, আধুনিক পরাবাস্তব কবিতা অপরাপর শিল্পকলার মতই একটি কলা বিশেষ। এর আছে শৈল্পিক সুষমার পাশাপাশি ভাবের গভীরতা ও বোধের উৎকর্ষতা। এতে অল্প কথায় অনেক গভীর এবং বহুমূখী বোধ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। বিবিধ চিত্রকল্পে নানান রূপক উপমা উৎপ্রেক্ষা ও সমাসোক্তির আড়ালে এর অন্তর্নিহিত বোধটি প্রচ্ছন্ন থাকে, পাঠককে তা ভাবনার প্রত্নখননে তুলে আনতে হয়। যা একটু কঠিন কাজ বৈকি, ভাববাদী মন ছাড়া এর রস সবাই উপভোগ করতে পারে না। স্বভাবতই সাধারণ পাঠকের কাছে একে দুর্বোধ্য বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু আধুনিক পরাবাস্তব কবিতায় ভাবনার অনেক খোরাক থাকে।


গ্রন্থে সংযোজিত ১৬টি কবিতার শিরোনামঃ


১। স্মৃতির শার্শি
২। আজব রহস্যসাগর
৩। পলকের দৃষ্টি
৪। নীরব সাক্ষ্যমনি
৫। নাগিনী বপুস্মতী
৬। অকাল শ্রাবণ
৭। স্বাধীনতার অধীনতা চাই
৮। মনান্তরের ভাষা
৯। কাপাস বেলা
১০। এ যাত্রার হলে অবসান
১১। বৃক্ষ
১২। সভ্যতার জয়রথ
১৩। আমার বিজয় আমার স্বাধীনতা
১৪।  মুখরা সুখের ইচ্ছেগুলো
১৫। জীবনের সুখটান
১৬। কবিতার কড়চা


আসরের পাতায় আমরা অনেকেই নানা সময়ে, পাঠক মন্তব্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে থাকি, গতানুগতিক মন্তব্য, কপি-পেষ্ট মন্তব্য, নিজের কবিতায় সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মন্তব্য, কবিতা না পড়েই মন্তব্য ইত্যাদি নানাভাবে নেগেটিভ ধারন পোষন করি এবং কখনো কখলো বলেও থাকি।


উষ্মা প্রকাশ  হয়তো অনেকাংশেই সত্যি, পাশাপাশি ভিন্ন এক সত্যও লুকানো আছে। অনিরুদ্ধ বুলবুল এর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যায়, কি অসাধারন সব মন্তব্য পাঠক থেকে এসেছে, কবিতার চুলচেরা বিশ্লেষন থেকে শুরু করে, শব্দের ব্যাখা, উপমার উপযোগীতা,, কবিতার কোন অংশ বুঝতে না পারলে তার স্বীকারোক্তি এবং পরবর্তীতে কবি’র প্রতিক্রিয়া মন্তব্যে তার ব্যাখা ইত্যাদি। ফলে “পাঠক মন্তব্য” সম্পর্কে আমাদের যতো উষ্মা প্রকাশ তা অনেকটাই দূরীভূত হয়ে যায় এই গ্রন্থের পাঠক মন্তব্যগুলো পড়তে পারলে। আমার এই স্পষ্ট উচ্চারনের স্বপক্ষে, গ্রন্থে প্রকাশিত কিছু ‘পাঠিক মন্তব্য” সরাসরি সংযুক্ত করছি-


স্মৃতির শার্শি কবিতায় একজন পাঠকের মন্তব্যঃ


মানুষ নামক প্রাণির বুকে শত শতাব্দী ধরে যে অভিমান জমে জমে পাথর হয়ে আছে, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তার স্মৃতি। জীবনের অনেক স্পন্দিত মুহূর্তের পল আর অনুপলগুলি স্মৃতির সাথে এক আশ্চর্য মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়।


স্মৃতির শার্শিতে ভেসে উঠে ধূসর অতীতের প্রতিবিম্ব; প্রথম স্তবকটি পড়ে মনে হল, ক্ষণে ক্ষণে পালটে যাচ্ছে অতীতের প্রতিবিম্বগুলির মোহিনী মুখচ্ছবি। গলে পড়ছে পাঠক মনের অভিমান, আশা, স্বপ্নের অতীত হয়ে যাওয়া মোমের পেলব বিন্দুগুলি।


পলকের দৃষ্টি কবিতায় একজন পাঠকের মন্তব্যঃ


কবিতার প্রাণ-এর ভাবে এবং বিষয়বস্তু।আর সেই সাথে শৈল্পিক বুননটাও প্রণিধানযোগ্য।


অফবিট ধরণের কবিতা আপনার কাছে খুব কম পাই, তবে এটা পেলাম এই কবিতার সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানে “আমি” এবং “ভালোলাগ সে” চরিত্র দু’টির চারিত্রিক মহিমা, উপলব্ধি, যাতনা, ত্যাগ প্রভৃতি চমৎকার উপমা দ্বারা চিত্রিত হয়েছে।


৩টি স্তবকের প্রথমটিতে প্রণয়-প্রলয়বোধ আবিস্কার করলাম। ২য়টিতে মৌমাতাল প্রেমের প্রগাঢ়তা এবং শেষটিতে প্রামাবিষ্ট বিমূর্ত ভাবনার উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। সবশেষে বরাবরের মতোই মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। চমৎকার শব্দের ব্যবহারেও চমৎকৃত হলাম।


কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল এর এ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ করার ভাবনাই আমার কাছে অসাধারন মনে হয়েছে। কবি, কবিতা এবং পাঠকের সাথে যোগযোগের রূপ এবং রূপকতা কেমন হতে পারে, গ্রন্থগুলো পড়লে বোঝা যায়। গ্রন্থটির উপর রিভিউ লেখার জন্য গত কয়েক দিন ধরেই বেশ সময় নিয়ে পড়ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, বাংলা কবিতার আসরে প্রতিদিন যে অসংখ্যা পাঠক মন্তব্য প্রকাশ হয়, সে গুলো জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার, শুধু সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিতে পারলে, পাঠক মন্তব্য থেকেই অনেক জ্ঞান আহরন করার সুযোগ আছে।


তবে এটাও সত্যি, কবি অনুরুদ্ধ বুলবুল বাছাই করা মন্তব্যগুলোই প্রকাশ করেছেন, এমন তো হতেই পারে ১০০টি মন্তব্য থেকে বাছাই করে মাত্র ১০টি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য পেয়েছেন এবং সেগুলোই প্রকাশ করেছেন বাকীগুলো মানোত্তীর্ণ হতে পারেনি কিংবা “মন্তব্য করার জন্যই মন্তব্য করা” টাইপের হয়েছে। ফলে , আমরা সবাই  একটু সচেতন হলে, বিনা কারনে অহেতুক “পিঠ চুলকানো” টাইপের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলে, পাঠক হিসেবে আমাদের অনেক সময়ের অপচয় কমে যাবে এবং প্রতিদিন অনেক মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করতে পারবো পাঠক মন্তব্য থেকেই।


কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল এর বাকী গ্রন্থগুলোও অচিরেই পড়ে ফেলবো আশা করি। কবি’র জন্য রইলো অশেষ শুভেচ্ছা রবং দারুন এক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য অভিনন্দন।